আপনারা যারা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ছেন বা এই বিষয় নিয়ে অনার্সে পড়ার ইচ্ছে করছেন তাদের উদ্দেশ্যেঃ ১ম কথা হলো, ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান’ লেখাপড়ার সিলেবাস কেমন ও রেজাল্ট কেমন হয়? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি যদি এককথায় বলি, তাহলে বলবো- সামাজিক/কলা অনুষদে এরচেয়ে সহজ ও যুগোপযোগী সাবজেক্ট আর ২য়টি নেই বললেই চলে। আনন্দদায়ক পাঠদান/গ্রহণের পাশাপাশি একটি চমৎকার রেজাল্ট করার সবচেয়ে অধিকতর উপায় রয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। তুলনামূলক ভাবে কম পরিশ্রমে সহজে পাস ও ভালো রেজাল্ট করার সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা রয়েছে এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান ক্যারিয়ার – রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ে কি হওয়া যায়
দেশ-বিদেশের রাজনীতি, সরকার, রাজনীতিবিদদের জীবনকাহিনী, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধ, দার্শনিকদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি, প্রশাসন, লোকপ্রশাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, শান্তি ও সংঘর্ষ, আইন, সংবিধান, রাজনৈতিক তত্ত্ব, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, কূটনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, নয়া বিশ্বব্যবস্থা প্রভৃতি হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রাণবন্ত সূচিপত্র। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো- হাতেগোনা কিছু বাদ দিলে, স্বল্প মেধাবী ও একাডেমিক রেজাল্ট খুব একটা ভালো নয় এবং আর্থিক অবস্থা ভালো নয় এই ধরনের শিক্ষার্থীরাই সবচেয়ে বেশি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়; যাতে কাজ/সংসার করে অন্তত পাসটা করা যায়। ফলে ব্যতিক্রম কিছু ছাড়া গুণগত ফলাফল ততোটা চোখে পড়ে না।
২য় কথা হলো, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ ও চাকরির বাজার কেমন? রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেহেতু স্কুলে দশম শ্রেণি বা কলেজ পর্যন্ত পড়ানো হয় না, তাই কেউ কেউ মনে করেন, ওটা তো আর স্কুল সাবজেক্ট নয়। তাই স্কুলে পড়ানো যদি জীবনের লক্ষ্য হয়, তাহলে তাঁর এই বিষয়ে নিয়ে পড়া উচিত নয়। আমি বলবো এসব কথার সত্যিকার কোনো ভিত্তি নেই। কারণ মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ‘পৌরনীতি ও সুশাসন ‘ নামে যেই বিষয়টি রয়েছে সেটাই হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অপর নাম। আসলে ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন হিন্দু পণ্ডিতদের প্রতাপে সংস্কৃত ভাষায় রাখা পৌরনীতি নামটি আজও রয়ে গেছে। বোর্ড ও মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবো মান্দাতার আমলের নাম পাল্টিয়ে ‘রাজনীতি ও সুশাসন ‘ কিংবা সরাসরি ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান ‘ নাম রাখাই সমীচীন ও যুগোপযোগী। অনেকে বিষয়ের নাম না বুঝাতেই এটাকে পৌরাণিক/প্রস্তর যুগের কাহিনী মনে করে। আমি জানিনা, আমাদের নীতি নির্ধাকরগণ আদৌ এবিষয়টি নিয়ে কোনোদিন ভেবেছেন কিনা?
কিন্তু স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর ক্ষেত্রে যদি কেউ শুধু রাষ্ট্রবিজ্ঞান চর্চা করতে পারেন, জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়া তার আটকাবে না। এখন দেখে নেওয়া যাক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান যদি কারও বিষয় হয়, তাহলে কেরিয়ারে কী কী অপশন খোলা রয়েছে? নানাবিধ ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১। বিসিএসে : এই বিভাগের সিলেবাসের সাথে বিসিএসের সিলেবাস অন্য বিষয়গুলোর তুলনায় সবচেয়ে বেশি মিল থাকায় উক্ত বিভাগের শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকতে পারেন।
২। প্রাথমিক শিক্ষায়ঃ বিজ্ঞানের গণিত, বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের প্রাথমিকে জব হওয়ার দৌঁড়ে অনেকটাই এগিয়ে থাকেন।
৩। মাধ্যমিক স্কুলে : আলাদাভাবে না থাকলেও সামাজিক বিজ্ঞানের পোস্ট গুলোতে অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালোই এগিয়ে থাকা যায়।
৪। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো: প্রথমত, অ্যাকাডেমিক লাইন তো খোলা আছেই। স্নাতকোত্তর স্তরে ৬০ শতাংশ নম্বর এবং নেট/সেট পাশ করলে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।
৫। গবেষণার কাজ : কেউ যদি না পড়িয়ে শুধুমাত্র গবেষণা করতে চায়, তবে তার সুযোগও ক্রমবর্ধমান। এমনিতেই ইউ জি সি-র ফেলোশিপ নিয়ে যে-কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু করা সম্ভব। গবেষণার বিষয় নানাবিধ হতে পারে।
সাধারণ ভাবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে রাজনৈতিক দর্শন, তুলনামূলক রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এই তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হলেও, জনসাধারণ, সমাজতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব প্রভৃতি নানাবিধ ক্ষেত্রে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। এ ছাড়াও মানবাধিকার, লিঙ্গবৈষম্য বা সেফোলজি-র মতো আকর্ষণীয় বিষয় চর্চার মাধ্যমে গবেষকদের চিন্তা ও কাজের পরিধি ক্রমশ বিস্তৃত হতে পারে। সাধারণত একটি গবেষণা আরও পাঁচটির সুযোগ ও পরিধিকে বিস্তৃত করে, নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়, কাজের সুযোগও বাড়ে।
৬। মিডিয়ায় কাজের সুযোগ: নির্বাচন প্রক্রিয়ার কোনও একটি পর্যায় নিয়ে কেউ সাধারণ নির্বাচকমণ্ডলীর একটি অংশের প্রতিক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা করতে চান। জানতে চান সাধারণের আচরণগত বৈশিষ্ট্য। সে ক্ষেত্রে নিজ গবেষণার পরিধি বাড়ালে অচিরেই তিনি এক জন ভোট-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন। এখন মিডিয়া প্রতিযোগিতার কালে তাঁর চাহিদা তখন বাড়তে পারে। এর জন্য গবেষককে অবশ্যই নিয়মিত লেখালেখি চালিয়ে যেতে হবে, নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। কিন্তু এক বার প্রতিষ্ঠিত হলে তাঁর পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না।
৭। সাংবাদিকতা: অবশ্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা সাংবাদিকতায় এলে সাফল্য পান। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমে প্রতিদিন আমরা যে খবরগুলিকে প্রধান হয়ে উঠতে দেখি বা যেগুলি নিয়ে নিয়মিত চর্চা-বিশ্লেষণ বা সম্পাদকীয় রচনা চলে, তার অধিকাংশই রাজনৈতিক। সে ক্ষেত্রে কেউ যদি স্নাতকস্তর পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠ করে তার পর সাংবাদিকতায় মনোনিবেশ করেন, তবে তাঁর সাফল্য সুনিশ্চিত।
৮। আইনের পথ খোলা: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা আইন ব্যবসাতেও অত্যন্ত সফল হন। সারা বিশ্বে লব্ধপ্রতিষ্ঠ যত জন আইনজ্ঞ রয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা অর্থনীতির পড়ুয়া। এখন উচ্চ মাধ্যমিকের পর সরাসরি আইন নিয়ে পড়া যায়। কিন্তু কেউ যদি স্নাতকস্তর পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ নিয়ে তার পর আইন পাঠ করেন, তবে আরও দ্রুত বিষয়ে প্রবেশ সম্ভব।
৯। রয়েছে NGO তে কাজএর সুযোগ: ছাড়াও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা বিভিন্ন এনজিও সংগঠনে কাজ পেতে পারেন। বিশেষত কেউ যদি সোশ্যাল ওয়ার্ক বা মাস কমিউনিকেশনের একটা পর্যায় পর্যন্ত পেশাদারি শিক্ষা লাভ করেন তো কথাই নেই। প্রকৃত সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে স্বাধীন গবেষণাকেন্দ্রও গড়ে তোলা সম্ভব। উচ্চশিক্ষায় গবেষণামূলক কাজে যত বেশি বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রসার ঘটবে, ততই গবেষকের স্বাধীনতা ও সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।
১০৷ প্রশাসনিক: এই স্তরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছেলেমেয়েদের চাকরির সুযোগ অনেক বেশি। পুলিশ, প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা সংস্থা, এসআই প্রভৃতি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারা সর্বদাই একটা কদর রয়েছে।
১১। ব্যাঙ্ক সেক্টর : এক্ষেত্রেও মেধাবী ও ভালো রেজাল্টধারীদের অবাধ বিচরণ রয়েছে।
১২। আন্তর্জাতিক বাজারে : রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের অভাবনীয় চাকরির সুযোগ রয়েছে।
১৩। বিভিন্ন দপ্তর/ অধিদপ্তর : সরকারের বিভিন্ন দপ্তর/ অধিদপ্তরে এই বিভাগের ছেলেমেয়েদের দারুণ চাহিদা রয়েছে।
১৪। মূলস্রোতের রাজনীতি: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য পড়ে আছে রাজনীতির প্রাঙ্গণ। মূলস্তরের রাজনীতিতে ‘নেতা’ হতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পড়ুয়ারাই যে এগিয়ে থাকবেন, তা বলাই বাহুল্য।
১৫। সহজ ও ভালো রেজাল্ট : রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রাইভেট বা কোচিংয়ের কোনো চাপ নেই বরং নিয়মিত ভাবে ক্লাস ও লেখাপড়ায় একটু মনোযোগ থাকলেই ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। তবে এই বিষয়টি সবচেয়ে বেশি নারী ও গরীব বান্ধব।
সর্বোপরি, আপনার অক্লান্ত পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ই আপনাকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। খাটার মালিক আপনি আর দেওয়ার মালিক আল্লাহ। যে নিজে খাটে না তাকে আল্লাহও দেন না। একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষার ব্যাপারেও জ্ঞান রাখুন এবং প্রস্তুতি নেওয়ার চেষ্টা করুন। নিজের মাঝে ইংরেজিতে কথা বলার অন্তত মোটামুটি দক্ষতা ও কম্পিউটার চালানোর কিছুটা ব্যবহারিক দক্ষতা রপ্ত করুন যা আপনার চলমান শিক্ষাজীবনে দৈনন্দিন প্রয়োজনে কাজে লাগবে এবং ব্যাঙ্কে জব করা যাদের প্রথম পছন্দ তাদের জন্য তো অবশ্যই। কারণ বিশ্বায়নের এই যুগে সর্বত্র সর্বদা পুঁথিগত বিদ্যা দিয়ে চলে না সেটা আপনি যেই বিষয়েই পড়ুন না কেন। কেননা- রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ে এমন অনেকেই আছেন যারা ইতিমধ্যে বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত হয়ে হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হয়েছেন।
মোঃ দেলোয়ার হোসেন
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ডেমরা কলেজ, ঢাকা-১৩৬০।
সহযোগিতায়ঃ political science