বিসিএসে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী ছিটকে পড়ে প্রিলিমিনারি পর্ব থেকে। তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এ পরীক্ষায় টিকতে হলে চাই জোর প্রস্তুতি। বিসিএসের প্রিলিমিনারির প্রস্তুতিতে করণীয় নিয়ে লিখেছেন ৩০তম বিসিএসে সম্মিলিত মেধাতালিকায় প্রথম সুশান্ত পাল-আজ আপনাদের জন্য তুলে ধরা হল
বিসিএস পরীক্ষার ডিফিকাল্টি লেভেল আমার কাছে কিছুটা ওভাররেটেড বলেই মনে হয়েছে। এটা তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটি পরীক্ষা-এটা যতটা সত্য, সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতায় আসার মতো প্রার্থী খুব বেশি সাধারণত থাকে না, এটা আরো বেশি সত্য। দুটি ফ্যাক্ট শেয়ার করি।
অবশ্যই পড়বেন সবাই
এক. এই এক্সামে ৫০ শতাংশ ক্যান্ডিডেট যায় জাস্ট ঘুরতে, কোনো কারণ ছাড়াই, অনেকটা গেট-টুগেদার করতে। (মজার ব্যাপার হলো, এদের কেউ কেউ সফলও হয়ে যায়! ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’ টাইপের আরকি!)
দুই. রিয়েল কম্পিটিটিশনে আসার মতো ক্যান্ডিডেট থাকে মাত্র ৭ শতাংশের মতো। এর মানে, আপনার কম্পিটিটর আপনি যতটা ভাবছেন, তত বেশি না।
প্রিলিমিনারির একটি সিলেবাস পিএসসি প্রণয়ন করে দিলেও প্রকৃত অর্থে বিসিএসের কোনো সুনির্দিষ্ট সিলেবাস নেই। এই পরীক্ষায় শত ভাগ প্রস্তুতি নেওয়া কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। ৩৫তম লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেছিলাম, শতভাগ শিখেছি ভেবে তার ৬০ শতাংশ ভুলে গিয়ে বাকি ৪০ শতাংশকে ঠিকমতো কাজে লাগানোই আর্ট। এই পরীক্ষার বেলায়ও কথাটি সমভাবে প্রযোজ্য। প্রিলিমিনারিতে ভালো করার জন্য কী কী পড়বেন, সেটা জানার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, কী কী বাদ দিয়ে পড়বেন, সেটা ঠিক করা।
৩৫তম বিসিএস প্রিলি : কিছু পর্যবেক্ষণ
* ক খ গ ঘ-এই সিরিয়ালটা বাম থেকে ডানে না দিয়ে ওপর-নিচে দেওয়ায় অনেক ক্যান্ডিডেটই অন্তত তিন-চারটা জানা প্রশ্নের উত্তর ভুল দাগিয়েছেন।
* এটি ‘এসো নিজেরা করি’ টাইপ কোনো প্রশ্ন না, তাই পরীক্ষার হলে কথা বলেও তেমন কোনো লাভ হয়নি।
* কোচিং সেন্টারে দৌড়ঝাঁপ করে আর গাইড বই পড়ে তেমন কোনো কাজই হবে না, যদি না নিজের মাথায় কিছু থাকে। ভালো প্রস্তুতি নেওয়া অপেক্ষা ভালো পরীক্ষা দেওয়াটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
* ‘অমুক কোচিং সেন্টারের সাজেশনে এত পার্সেন্ট কমন’, ‘তমুক গাইডের এতসংখ্যক প্রশ্ন কমন’-
এসব কথা বলার দিন শেষ হতে চলেছে, এটা আমার মনে হয়েছে।
অবশ্যই মাথায় রাখবেন
* একেকভাবে ভাবলে একেক রকম উত্তর হয়-এমন প্রশ্ন অন্যান্যবারের তুলনায় গেল প্রিলিমিনারিতে বেশি ছিল। পিএসসি ইচ্ছা করেই এ গেমটা খেলে, যাতে কেউ সেগুলো উত্তর না করে। নেগেটিভ মার্কিংয়ের ফাঁদে পড়ে বিসিএসের আসর থেকে ছিটকে পড়েছেন অনেকেই। লোভে পাপ, পাপে নেগেটিভ মার্কস!
* প্রশ্নটি ভালোভাবে দেখলে খেয়াল করবেন, আপনার অ্যাকাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড যা-ই হোক না কেন, আপনি কোনো বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন না।
* এখন থেকে সব সময় পরীক্ষা এ স্টাইলেই হলে প্রশ্নব্যাংক, ডাইজেস্ট, জব সলিউশন, কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য কমে যাবে কিংবা ওদের সেবাদানের ধরন বদলাতে হবে। স্রেফ মুখস্থ বিদ্যার জোরে আমলাতন্ত্রে আসারও দিন শেষ।
বাংলা বিষয়ের প্রস্তুতি:
ধারাবাহিক আয়োজনে বিষয়ভিত্তিক প্রস্তুতি নিয়ে লিখব। আজ প্রথম পর্বে থাকছে বাংলা বিষয়ে কিছু আলোচনা। বাংলা মাতৃভাষা হওয়ায় অনেকের কাছেই মনে হতে পারে, ভালো প্রস্তুতি না নিয়েও এ বিষয়ে ভালো মার্কস পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নিয়মই হলো, সহজ মার্কসটি যায় না পাওয়া সহজে।
বাংলার জন্য আগের বিসিএস পরীক্ষা আর জব সলিউশনের ভাষা ও সাহিত্যের প্রশ্নগুলো পড়ে ফেলুন। ওখান থেকে অত কমন হয়তো পাবেন না, কিন্তু একটা ধারণা পাবেন-কোন ধরনের প্রশ্ন আপনি পড়বেন কিংবা বাদ দিয়ে পড়বেন! যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার ক্ষেত্রে এ প্রশ্নের প্যাটার্ন ম্যাপিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
ভাষা
কোথা থেকে পড়বেন?
আগের বিসিএস পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন+ জব সলিউশন+ নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ বই+ হায়াৎ মামুদের ভাষা-শিক্ষা+গাইড বই
কিভাবে পড়বেন?
সিলেবাসটা ভালো করে দেখে নিন। কোন কোন টপিক আছে তা একটা কাগজে লিখে ফেলুন। এরপর টপিক ধরে ধরে ব্যাকরণ আর গাইড বইয়ের সেই অধ্যায়গুলো ভালোভাবে দাগিয়ে বারবার পড়ুন। যে প্রশ্নগুলো বারবার পড়লেও মনে থাকে না, সেগুলো মনে রাখার চিন্তা বাদ দিন। একটা কঠিন প্রশ্নেও ১ নম্বর, একটা সহজ প্রশ্নেও ১ নম্বর। ৫ নম্বরের কঠিন প্রশ্নের পেছনে সময় দেওয়ার চেয়ে বরং ২০ নম্বরের সহজ প্রশ্নের পেছনে সেই একই সময় দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। জোর করে আর আবেগ দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে বুঝেশুনে পড়ুন।
সাহিত্য
কোথা থেকে পড়বেন?
আগের বিসিএস পরীক্ষাগুলোর প্রশ্ন+জব সলিউশন+সৌমিত্র শেখরের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা+হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলি+মাহবুবুল আলমের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস+গাইড বই
কিভাবে পড়বেন?
আগের বিসিএস প্রিলিমিনারি আর লিখিত পরীক্ষার প্রশ্ন স্টাডি করে কোন ধরনের প্রশ্ন আসে, কোন ধরনের প্রশ্ন আসে না, সে সম্পর্কে ভালো ধারণা নিন। এরপর রেফারেন্স বই দাগিয়ে বাদ দিয়ে দিয়ে পড়বেন। রেফারেন্স বইয়ের সবটুকু কাজে লাগে না, তাই সবটুকু পড়ার সহজাত লোভ সামলাতে শিখুন। খুবই ভালো হয়, যদি সাহিত্য অংশটি পড়ার সময় লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলা যায়। কারণ এর জন্য বাড়তি কোনো কষ্ট করতে হবে না আপনাকে।
মুখস্থ করার চেষ্টা না করে বারবার পড়ে মনে রাখার চেষ্টা করা উত্তম। পরীক্ষার হলে কিছু প্রশ্নের উত্তর কিছুতেই পারবেন না-এটা মাথায় রেখে সাহিত্য অংশের প্রস্তুতি নিন, দেখবেন মাথা ঠাণ্ডা থাকবে, অন্যান্য বিষয়ের প্রস্তুতিও ভালো হবে।
কিছু টিপস:
* দুই-তিনটা জব সলিউশন কিনে দশম থেকে ৩৫তম বিসিএস ও পিএসসির নন-ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্নগুলো (সম্ভব হলে অন্তত ২৫০-৩০০ সেট) বুঝে সলভ করে ফেলুন। দাগিয়ে রিভিশন দিন অন্তত দুই-তিনবার।
* দুই সেট রিটেনের গাইড বই কিনে আগের বছরের প্রশ্ন পড়ে ফেলুন। যে টপিকগুলো প্রিলির সঙ্গে মিলে সেগুলো সিলেবাস ধরে পড়ে শেষ করে ফেলুন। এতে আপনার রিটেনের অর্ধেকেরও বেশি পড়া হয়ে যাবে। রিটেনের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি পড়া প্রিলির সঙ্গে মিলে যায়।
* প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে দৈনিক পত্রিকা, ইন্টারনেট আর রেফারেন্স বই। কষ্ট হলেও রেফারেন্স বই ওল্টাতে পারলে প্রিলিমিনারি আর রিটেন দুটোতেই লাভ হবে।
* অনেকে প্রথমে রেফারেন্স বই পড়ে, পরে প্রশ্ন সলভ করে। এতে দুইটা সমস্যা আছে। এক. বেশি প্রশ্ন সলভ করার সময় পাওয়া যায় না। যত বেশি প্রশ্ন সলভ করবেন, ততই লাভ। দুই. রেফারেন্স বইগুলোর বেশির ভাগ অংশই বিসিএস পরীক্ষার জন্য কাজে লাগে না, অথচ পুরো বই পড়তে গিয়ে সময় নষ্ট হয় এবং বিসিএস নিয়ে অহেতুক ভীতি তৈরি হয়। তা ছাড়া অত কিছু মনে রাখার দরকারও নেই। তাই উল্টো পথে হাঁটুন। আমিও তা-ই করেছিলাম।