জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ টু টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ টু টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ “(A tale of utmost patience)”। ২১ মার্চ ২০২৩, এক বছর আগে এই দিনে জার্মানিতে প্রথম পা রেখেছিলাম। যারা জার্মানিতে উচ্চ শিক্ষার জন্য আগমনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অথবা এই সম্পর্কে ধারনা রাখেন তারা শিরোনামের যথার্থতা এতক্ষণে বুঝে নিয়েছেন। এই একবছরে অনেকবার নিজের জার্নি সম্পর্কে লিখব ভেবেছি, কিন্তু এখানে আসার পর এমন অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয় যে আর লিখা হয়ে উঠেনি। এক বছর কীভাবে কেটেছে টেরই পাইনি।

আজ আর নিজের ধৈর্য এবং একাগ্রতার স্তুতি টানার ইচ্ছে নেই যদিও লেখার শিরোনামে ভিন্ন ইঙ্গিত দিয়েছি। শুধু এটুকুই বলব যে সেশন জ্যাম, কোভিড, লকডাউন, এম্বাসি ওয়েটিং পিরিয়ড মিলিয়ে একাডেমিক লাইফ থেকে পাঁচ বছর গচ্ছা গেছে। আমার আজকের লিখার উদ্দেশ্য জার্মানিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য সম্ভাবনা ও খুটিনাটি এবং বিশেষ করে টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখে সুযোগ পাবার সম্ভাব্যতা। আমি একে একে বিভিন্ন গ্রুপে এবং আমার ইনবক্সে আসা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ফ্রিকুয়েন্টলি আস্কড কোয়েশ্চেনগুলোর উত্তর করার চেষ্টা করব যেগুলো অনেকেরই জানা আছে বা থাকতে পারে, তাই চাইলে এড়িয়ে যেতে পারেন। শেষধাপে TUM এ আমার সুযোগ পাওয়া এবং চলমান জার্নি নিয়ে কিছু আলোচনা করব।

 

১. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জার্মানিতে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করতে পারবে কিনা?

এই আনাড়ি ধাঁচের প্রশ্নটি মাসে অন্তত দুই চারবার বিভিন্ন গ্রুপে চোখে পড়ে। এক কথায় উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ পারবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় দেশের আর দশটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই একটি পূর্নাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের অনেক লো ক্লাস প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও উন্নত সিলেবাস তার। তাহলে সমস্যা কোথায়, কেন সবাই এটিকে ছোট করে দেখে? সমস্যা রিসোর্স, বাজেট, ছাত্রদের পড়াশুনা না করে শুধু ডিগ্রী অর্জনের মানসিকতা এবং দেশের আভিজাত্যপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শিক্ষিত সমাজের অবজ্ঞাপূর্ণ মন্তব্য। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পরেও অনেকে নিজের প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নুন্যতম জ্ঞান রাখে না।

যাইহোক সেগুলো অন্য আলোচনা। আপনি যখন বিদেশি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করবেন তারা দেখবে না আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, বরং তারা দেখবে আপনার একাডেমিক রেকর্ডস, IELTS, রিকোমেন্ডেশন, আপনার মোটিভেশন এসব জিনিস। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়টি নাম সর্বস্য না হলেই হলো। এক্ষেত্রে জার্মানিতে গ্রহণযোগ্য বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি লিংক দিচ্ছি।

জেনে আশ্চর্য হবেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ও এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত।

২. আবেদন করতে কি কি লাগবে?

ইংরেজি অথবা জার্মান ভাষার দক্ষতা, ভালো ফলাফল, একাডেমিক সার্টিফিকেট, একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্ট, ইউরোপিয়ান স্টান্ডার্ড সিভি, বিভাগীয় শিক্ষকের রিকমেন্ডেশন লেটার, মোটিভেশন লেটার ইত্যাদি। অনেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কশীট ও ট্রন্সক্রিপ্ট নিয়ে কনফিউসড হয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয় আপনাকে যেটি প্রদান করে সেটি মার্কশীট যেখানে বিষয়ের নাম উল্লেখ নেই, আপনাকে অবশ্যই গাজীপুর থেকে ট্রান্সক্রিপ্ট সংগ্রহ করতে হবে। গুগল করলেই অনলাইনে ট্রান্সক্রিপ্টের আবেদন প্রকৃয়া পেয়ে যাবেন।

৩. জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদনের যোগ্যতা কি?

আবেদনের যোগ্যতা বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে সিজিপিএ ন্যূনতম ৩.০০ এবং IELTS ন্যূনতম ৬ থাকা সেইফ।

৪. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে MOI নেওয়া যায় কিনা?

MOI এর পূর্ণরুপ Medium of Instruction, যার বাংলা দাঁড়ায় পড়াশুনার মাধ্যম। আমরা সবাই জানি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়াশুনা হয় (কিছু প্রফেশনাল কোর্স ব্যতীত)। সুতরাং, মাধ্যম বাংলা দেখিয়ে MOI অবশ্যই নেওয়া যায়, আর যদি ইংরেজি মাধ্যম দেখিয়ে দুই নাম্বার গলি অনুসরণ করে কিছু বানিয়ে নেন সেটা অবশ্যই ক্রাইম। তাই ক্রাইম করার সময় অর্থাৎ যাত্রার শুরুতেই ক্রিমিনাল হওয়ার সময় নিজ দায়ীত্বে করবেন বা হবেন। আমি অনুরোধ করব এটি না করার জন্য কারণ কখনো ধরা পড়লে নিজের পাশাপাশি আপনি আপনার অনুজদের পথ দূর্গম করে তুললেন।

MOI দিয়ে ভালো কোথাও এডমিশন নিয়ে এরপর IELTS/TOEFL দিয়ে এম্বাসি ফেইস করবেন? বিশ্বাস রাখুন আপনার পথটাকে জটিল করে নিলেন আপনি। আর তাছাড়া যেহেতু এম্বাসিতেIELTS/TOEFL এর ফলাফল আপনাকে দেখাতেই হবে তাই অতি আবেগে MOI নিয়ে আদৌতে তেমন কোন লাভও নেই। অনেকেই যুক্তি দেন যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ আছে, তার উত্তরে আমি বলব কেউ সেই সুযোগ নিতে শুনেছেন বা দেখেছেন? নিলে সেটি সারা বংলাদেশে কতজন? সেটির পরিমান কি গণহারে MOI নেওয়ার মতো? আমার অন্তত জানা নেই। সব কথার শেষ কথা, IELTS দিতে ভয় পেলে বিদেশে পড়াশুনা আপনার জন্য নয়।

৫. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরে ২৫% ক্রেডিট কমপ্লিট করে ব্যাচেলরে আবেদন সম্ভব কিনা?

হ্যাঁ সম্ভব। আমি আগেই বলেছি যে এটি একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।

৬. আমার বা যারা যারা বিদেশে পড়তে এসেছে তাদের IELTS স্কোর কত?

সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। আপনার ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আপনি কত স্কোর করেতে পারেন তার উপর। লক্ষ স্থির রাখুন, আপনি সফল হবেন।

এবার আসি আমার TUM এ সুযোগ পাবার গল্পে।

আবেদন প্রকৃয়ার শুরুতে TUM সম্পর্কে তেমন ধারনা ছিলনা আমার। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং এর চেয়ে প্রায়োগিক বিষয় পাবার প্রতি বেশি নজর ছিল কারণ আমার অলরেডি ফিজিক্সে স্নাতকোত্তর করা আছে। সেই উদ্দেশ্যে কোর্স খুঁজতে গিয়ে TUM এর এই কোর্সটি খুঁজে পাই। কিছু না বুঝেই চয়েস লিস্টে নিয়ে আসি। ধীরে ধীরে আবেদন প্রকৃয়া নিয়ে ধারনা বাড়তে থাকে এবং আবেদন শুরু করতে গিয়ে জানতে পারি TUM এখানকার সেরা বিশ্ববিদ্যালয় আর আমার এখানে সুযোগ হবার সম্ভাবনা কম। যে কোর্সটি সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে সেটিতে সুযোগ পাবনা নিজের মনকে বুঝাতে পারিনি। যা হবার হবে, আবেদন করার সিদ্ধান্ত বহাল রাখি।

নিজের সমস্ত মনযোগ এই আবেদনের পিছনে ব্যয় করি। সমস্যা বাঁধে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লম্বা সেশন জ্যাম নিয়ে। ওদেরকে বুঝাতে পুরো একমাস লেগেছিল যে এটা আমার স্টাডি গ্যাপ নয়, কিন্তু তাদের প্রশ্ন ঘুরেফিরে একটাই ২০১৫ তে ব্যাচেলর এবং ২০১৬ তে মাস্টার্স হলে আমি ২০১৯ পর্যন্ত সিভিতে পড়াশুনা দেখাচ্ছি কোন যুক্তিতে। যাইহোক, শেষ পর্যন্ত আমি বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে আমার কমতি নয়, সিস্টেমের কমতি। ততদিনে এডমিশন কমিটির কয়েকটি মিটিং হয়ে গেছে এবং তারা আমার ফাইল নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।

আমি এগুলো জানতাম কারণ কোর্স সমন্বয়কের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছিলো আমার থিসিস আছে কিনা এই ব্যাপারটা নিয়ে (উল্লেখ্য আমার মাস্টার্স এ থিসিস করার অপশন ছিল যেটি আমি নিজেও জানতামনা আবেদনের কাজ শুরু করার আগে)। এর মধ্যে ক্রিস্টমাসের লম্বা ছুটিতে চলে যায় সবাই। অবশেষে ফেব্রুয়ারীর ১৫ তারিখ আমাকে জানানো হয় আমি কোনপ্রকার এন্ট্রেন্স এক্সাম ছাড়া সরাসরি ভর্তি হবার জন্য পর্যাপ্ত পয়েন্ট অর্জন করেছি। সুতরাং, আমাকে সুযোগ গ্রহণ করার বা সুযোগ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়। আমি অকপটেই সুযোগটা গ্রহণ করি। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে এখনো চালিয়ে যাচ্ছি এবং একবারও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবর্তনের চিন্তা মাথায় আনতে হয়নি। TUM এর সেমিস্টার প্রতি বাধ্যবাধকতা এখন পর্যন্ত পূরণ করতে পেরেছি। যদিও এর জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপার্জন করা থেকে বিরত থাকতে হয়েছে। আল্লাহ সহায় থাকলে বাকিটুকুও সফলতার সাথে সম্পন্ন করব ইনশাআল্লাহ্‌।

আমার TUM এ পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে আগ্রহীদের প্রতি কিছু পরামর্শ:

১. আপনার যদি নিজের পঠিত বিষয়ের উপর যথাযথ দখল না থাকে, অর্থাৎ শুধুমাত্র ডিগ্রী অর্জনের জন্য পূর্বে পড়াশুনা করে থাকেন এবং এখানে আসার পরপরই প্রচুর টাকা আয় করার ইচ্ছা পোষন করে থাকেন তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আপনার TUM এ না আসাই ভালো। এটি আমার ব্যক্তিগত মতামত, কিন্তু আপনার আত্মবিশ্বাস থাকলে বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। মনে রাখবেন, মিউনিখকে জার্মানির সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর ধরা হয়।

২. এখানে আসার পর ইংরেজি মাধ্যমে মানিয়ে নিতে অনেক কষ্ট হয়েছে। জানি বলবেন IELTS আছে, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়ার জন্য IELTS যথেষ্ট নয়। তাই আমার পরামর্শ থাকবে পৃথীবীর যে প্রান্তেই পড়তে যান নিজের বিষয়ের কিছু ইংরেজি লেকচার বারবার দেখা এবং বিভিন্ন জার্নালে আর্টিক্যাল পড়ার অভ্যাস করুন।

৩. নিজের বিগত বা চলমান কোর্সের এডভান্স লেভেলের (সাধারণত ৩য় ও ৪র্থ বর্ষের) বিষয়গুলো ভাল করে ঝালিয়ে নিন এবং অবশ্যই সিলেবাসের কোন টপিক বাদ দিয়ে যাবেন না।

৪. TUM এর কোন কোর্স পছন্দ হলে আবেদন করতে পিছ পা হবেন না বা এই ভেবে ভয় পাবেন না যে আপনি সুযোগ পাবেন না। বিশ্বাস করুন আবেদন করতে গিয়ে অনেক কিছু জেনেছি, শিখেছি। আবেদনের যোগ্যতা মিলে গেলে আবেদন করুন।

৫. অবসর সময়ে নিজের দক্ষতার উন্নয়ন করুন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জার্মান ভাষা দক্ষতা এবং একটি প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজ দক্ষতা।

দুইটি অনুরোধ:

১. বানান এবং ইংরেজি বাংলার মিশ্রনজনিত ত্রুটি মার্জনীয় হিসেবে দেখবেন দয়া করে। চেষ্টা করি এগুলো এড়িয়ে চলার কিন্তু একজন মানুষ তো আর সর্ববিদ্যাবিশারদ নয়।

২. আমার ইনবক্স প্রশ্নবানে জর্জরিত করবেন না দয়াকরে। অন্তত পর্যাপ্ত রিসার্চ করার পর যদি প্রশ্ন থাকে সেটি করুন। নচেত উত্তর পাবেন না কারণ আপনার প্রশ্ন দেখলেই আমি বুঝে যাব যে আপনি ন্যুনতম রিসার্চ করেননি।

আমার পোস্ট থেকে যদি একজনও উপকৃত হয়ে থাকে অথবা একজনও TUM এ আবেদন করার সাহস পায় তবেই এই পোস্ট স্বার্থক। সবার জন্য অফুরন্ত শুভকামনা।

 

মোঃ হানিফ (মিশু)

স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ),
নোয়াখালী সরকারি কলেজ।

MSc. in Applied and Engineering Physics,
Technische Universität München.

About Nazmul Hasan

Hi! I'm Nazmul Hasan. From Koyra, Khulna. I'm Student of Under National University of Govt. B. L. College, Khulna, Department of Political Science....

Check Also

অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা কবে হবে ২০২২

সরকারি ব্রজলাল কলেজ উপবৃত্তি বিজ্ঞপ্তি ২০২৪ – আবেদন ফরম ডাউনলোড লিংক

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ ১৮/০১/২০২৪ খ্রি. মোতাবেক সরকারি ব্রজলাল কলেজ, খুলনায় উচ্চ মাধ্যমিক …