প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে কোটা প্রথা ২০২৩

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে কোটা নিয়ে কিছু প্রশ্ন। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সহকারী শিক্ষক পদে অতিসম্প্রতি ৩৭ হাজারের বেশি প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা জেনে সবারই ভালো লাগার কথা। শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তিস্তরে তাঁরা পাঠদান করবেন। শিক্ষকঘাটতি পূরণ করতেও এ নিয়োগ সুফল দেবে কিছুটা। এত তরুণ-তরুণীর একসঙ্গে নিয়োগ পাওয়াও দেশের চাকরির বাজারের জন্য সুসংবাদই বটে। তবে এর ভেতর কিছুটা ক্ষোভও লক্ষ করা যাচ্ছে।

আরও পড়ুনঃ প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ২০২৩

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে কোটা প্রথা ২০২৩

সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, এ ক্ষোভ নিয়োগ পরীক্ষার কোনো ত্রুটি–বিচ্যুতি নিয়ে নয়। পূর্বনির্ধারিত যথাযথ নিয়মনীতি মেনেই হয়েছে নিয়োগ পরীক্ষার সব পর্ব। তবে উল্লেখ করতে হয়, নিয়োগবিধি অনুসারে এ চাকরির শূন্য পদ পূরণ করতে হয় প্রতি উপজেলায় যথাক্রমে ৬০ ও ২০ শতাংশ পদে নারী ও শিক্ষক কর্মচারীর পোষ্যদের মধ্য থেকে। উন্মুক্ত রয়েছে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ। সেটাকে মেধা কিংবা সাধারণ কোটা বলে উল্লেখ করা যায়। উল্লিখিত কোটাব্যবস্থার যৌক্তিকতা নিয়ে এখানে প্রশ্ন আসছে। দাবি উঠছে, এগুলো রদ করে পুরো মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য। উল্লেখ করতে হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকের পদটি বেতন স্কেলের ১৩তম গ্রেডে।

তিন–চার বছর আগে নিয়োগ পর্বে সব চাকরিতে ব্যাপকভিত্তিক কোটাব্যবস্থা ব্যাপক জন–অসন্তোষের ভেতর অনেক পর্যালোচনা করে আলোচ্য গ্রেড পর্যন্ত বাতিল করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, এ স্তর পর্যন্ত নিয়োগ পর্বে শুধু মেধাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সুতরাং দাবিটি উপেক্ষা করার মতো—এমনও বলা যাবে না।

বিষয়টি বিভিন্ন আঙ্গিকে বিবেচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমে বলতে হয়, এ পদ বেতন স্কেলের এক ধাপ নিচে ছিল। শিক্ষকদের জোরদার দাবির মুখে উন্নীত করা হয় এটি। সুতরাং সোজাসাপটা বলার থাকে, পদের মান ও সঙ্গে বেতন–ভাতাদি বৃদ্ধির পাশাপাশি এর নিয়োগের বিধানও কোটাসংক্রান্ত সরকারের প্রচলিত সাধারণ নীতিমালার আওতায়ই আসার কথা। সে অনুসারে সংশোধন হওয়া প্রয়োজন প্রচলিত নিয়োগ বিধি এবং কোটা সংরক্ষণবিষয়ক বিধানগুলোর।

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের এখনো সমাজের অনগ্রসর অংশ বলে বিবেচনা করা যায়। তবে শিক্ষক–কর্মচারীর পোষ্যদের এ ধরনের বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির সুবিধাদি এখন অতীতের তুলনায় অনেক আকর্ষণীয়। তাই থাকুক। তবে অবশ্যই বলতে হবে, তাদের কর্মসময় বেশ কম। ছুটিছাটাও রয়েছে যথেষ্ট।

কিন্তু তা হয়নি। তবে এ ধরনের কিছু করতে গোটা বিষয়টিকে খোলা মন নিয়ে পর্যালোচনা করা দরকার। কোটাসংক্রান্ত সরকারের ব্যাপকভিত্তিক সিদ্ধান্তটির ব্যতিক্রমও ক্ষেত্রবিশেষে হতে পারে। ভিত্তিস্তরে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পর্যায়েও থাকতে পারে এর কিছু আবশ্যকতা। প্রথমেই আসে নারীদের জন্য ৬০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের বিষয়টি। ১৯৭০ ও ৮০–এর দশকে সংযোজন ও সম্প্রসারণ হয় এতদসংক্রান্ত বিধানের।

বলা হয়েছিল, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শিশু। শিশুদের সঙ্গে লালন–পালনের পাশাপাশি বেড়ে ওঠার পর্যায়ে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও নারীর একটি সহজাত সম্পর্ক রয়েছে। তাদের এ স্থান পুরুষেরা পুরোপুরি পূরণ করতে পারেন না। তদুপরি নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নেও অধিক কর্মসংস্থান আবশ্যক তাঁদের।

আর আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষিত নারীর কর্মসংস্থানের একটি আদর্শ ক্ষেত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। কেননা প্রধানত কাজটি অনেকটা স্থানীয় পর্যায়ে। আর কর্মঘণ্টাও প্রকৃতপক্ষে কম। এসব যুক্তি ফেলার মতো নয়। তবে বাস্তবতা পরিবর্তনশীল।
এখন মেয়েরা পাবলিক পরীক্ষাসহ লেখাপড়ায় ভালো করছেন। বিসিএস ও বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মর্যাদাসম্পন্ন পদগুলোয় নিয়োগ পাচ্ছেন তাঁরা মেধার জোরে। চাকরি করছেন যোগ্যতার সঙ্গে। সচিবসহ সরকারের অনেক দায়িত্বপূর্ণ অবস্থানে পদায়ন হচ্ছে তাঁদের। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে এখনো মেয়েদের কিছু সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে। তবে এর পরিমাণ দ্রুত কমিয়ে আনা দরকার।

কেননা এভাবে নিয়োগ দিতে গিয়ে সম্মিলিত মেধাতালিকা থেকে সাধারণত ওপরের দিকে অবস্থানকারী পুরুষ প্রার্থীদের বাদ দিয়ে নিচের দিক থেকে নিয়োগ দিতে হয়। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার মান উন্নীত না হয়ে হচ্ছে ক্রম নিম্নমুখী। এর নেতিবাচক প্রভাব সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ার কথা এবং পড়েছেও। দীর্ঘদিন ধরেই তো চলছে ব্যবস্থাটি। এবার পেছনের দিকে ফিরে দেখার সময় হয়েছে।

একটি ছোটখাটো জরিপ পরিচালনা করলেই উপরোক্ত দাবির সত্যতা পাওয়া যাবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের প্রাধিকার কোটার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া যৌক্তিক হবে। এটা ২০ শতাংশ নির্ধারিত হলে প্রতিযোগিতার মাধ্যমেও তাঁদের কিছু অন্তর্ভুক্তি সামগ্রিক অনুপাত ৫০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যাবে।

এরপর আসছে পোষ্য কোটা প্রসঙ্গে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক–কর্মচারীদের পোষ্যদের নিয়ে শতকরা ২০টি পদ কোন যুক্তিতে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, সেটা বোধগম্য নয়। সংবিধান বলছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে সকলের নিয়োগ লাভের সমান অধিকার থাকবে।’ এর সোজাসাপটা ব্যাখ্যা হলো, নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। তবে সমাজের অনগ্রসর শ্রেণির জন্য চাকরি সংরক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থার ক্ষমতাও সংবিধান সরকারকে দিয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নারীদের এখনো সমাজের অনগ্রসর অংশ বলে বিবেচনা করা যায়। তবে শিক্ষক–কর্মচারীর পোষ্যদের এ ধরনের বিবেচনার কোনো সুযোগ নেই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির সুবিধাদি এখন অতীতের তুলনায় অনেক আকর্ষণীয়। তাই থাকুক। তবে অবশ্যই বলতে হবে, তাদের কর্মসময় বেশ কম। ছুটিছাটাও রয়েছে যথেষ্ট।

এর মধ্যেও দূরদূরান্তের প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষকদের উপস্থিতি সাধারণত অনিয়মিত বলে প্রতিষ্ঠিত ও সংগত অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য এমনটা সবাই করেন, তা নয়। শ্রেণি হিসেবে তারা সমাজে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও মর্যাদাসম্পন্ন হলেও দায়িত্ব সম্পাদনে তাদের অনীহা ও ক্রমনিম্নমান সম্পর্কে অনেক জরিপ থেকে জানা যায়। মাঠ প্রশাসনে আমার দীর্ঘকালীন চাকরির অভিজ্ঞতাও তা–ই বলে।<

মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও অভিযোগ করেন যে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের ভর্তির জন্য তাঁরা নিম্নমানের শিক্ষার্থী পেয়ে থাকেন। বিষয়টা সর্বতোভাবে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। ক্রমক্ষয়িষ্ণু শিক্ষার মান নিয়ে সতত যে আলোচনা হয়ে থাকে, তার সূচনা প্রাথমিক থেকে।

এ বিষয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত করা অনাবশ্যক। তবে বিনা দ্বিধায় বলা চলে, আইনত ও ন্যায়ত কোনো কারণেই নিয়োগের জন্য তাদের পোষ্যরা কোনো কোটা পেতে পারে না। এ ধরনের অনৈতিক ও সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোটা তারা ছাড়া রেলওয়েসহ আরও কিছু স্থানেও রয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলন চাঙা হলে সরকার জেদ না ধরে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত নিয়োগ পর্যায়ে সব কোটা রদ করে। কাজটি হয় বর্তমান সরকারের সময়কালেই। মেধাকে দেওয়া হয় প্রাধান্য। এ ক্ষেত্রে যেকোনো স্তরেই (এমনকি ২০তম গ্রেডেও) পোষ্য কোটায় নিয়োগ সব চাকরিতে বন্ধ করা দরকার।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের নিয়োগ পর্যায়ে সব কোটা বাদ দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে না। একটি পরিমাণে নারী কোটা আরও কিছুকাল চালু রাখার বিষয়টি অনেকেই যৌক্তিক বলে মনে করেন। পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী হিসেবে ক্ষমতায়নের প্রয়োজনে এবং শিশুদের সঙ্গে সহজাত নৈকট্যের বিবেচনায় ২০ শতাংশ শূন্য পদ আপাতত তাঁদের জন্য সংরক্ষণ করা যায়।

ফলে শতকরা ৮০ জন নিয়োগ পাবেন মেধার ভিত্তিতে। তাঁদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই বেশ কিছু নারীও থাকবেন। এভাবে কয়েক বছর চলার পর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, নারী শিক্ষকের অনুপাত ইত্যাদি জরিপ করে আবারও প্রয়োজন হলে সে ব্যবস্থায় সংশোধন আসতে পারে।

মূলত আমরা চাই, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও ভিত মজবুত হোক। আর এর প্রয়োজনে তুলনামূলক যাঁরা মেধাবী, সহকারী শিক্ষক নিয়োগকালে থাকুক তাঁদের প্রাধান্য। এতে ধীরে ধীরে হলেও মান উন্নীত হওয়ার কথা দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার। এর সুফল কালক্রমে প্রভাব রাখবে ওপরের স্তরগুলোয়।

আলী ইমাম মজুমদার
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

About Nazmul Hasan

Hi! I'm Nazmul Hasan. From Koyra, Khulna. I'm Student of Under National University of Govt. B. L. College, Khulna, Department of Political Science....

Check Also

সি গ্রেড ফার্মাসিস্ট কোর্স ফলাফল ২০২৪ – C Grade Pharmacist Result 2024

সি গ্রেড ফার্মাসিস্ট কোর্স ৬৩ তম ব্যাচের রেজাল্ট প্রকাশ। সি গ্রেড ফার্মাসিস্ট কোর্স ৬৩ তম …