১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ইডেন মহিলা কলেজের ক্যাম্পাস ছিল বকশীবাজারে। এখন এ স্থানে রয়েছে বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ। কলেজ কর্তৃপক্ষ বাধা দিলেও একুশের সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন ইডেনের ছাত্রীরা।
তখন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কলেজের ছাত্রীদের কোনো কর্মসূচি বা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ছিল মারাত্মক অপরাধ। আন্দোলনে যুক্ত হলে পরিবার থেকেই ছাত্রীদের পড়াশোনা বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হতো। এসব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে একুশের আন্দোলনে জড়িত হন এ কলেজের মেয়েরা। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়; দেশের নারী প্রগতির ধারাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলেছে বাংলার প্রথম নারী বিদ্যাপীঠ ইডেন মহিলা কলেজ।
১৮৭৩ সালে সমাজসেবামূলক সংগঠন শুভসাধিনী সভা ফরাশগঞ্জে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল গড়ে তোলে। ১৮৭৮ সালে তৎকালীন গভর্নর স্যার অ্যাসলি ইডেনের নামানুসারে এর নামকরণ হয় ইডেন গার্লস স্কুল। কালের বিবর্তনে সেটিই এখন ইডেন মহিলা কলেজ। এ কলেজেরই ছাত্রী ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। ভাষা আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন এ কলেজের ছাত্রীরা। কিন্তু এ কলেজের কি পুরনো, কি নতুন কোনো ক্যাম্পাসেই ভাষা আন্দোলনের সেসব দিনের চিহ্নমাত্র নেই। নেই তথ্য সংবলিত কোনো স্মারক, ফলক কিংবা বোর্ড। বড় বড় অট্টালিকার ভিড়ে হারিয়ে গেছে প্রাক্তনীদের অসীম সাহসিকতার অনন্য ইতিহাস।
অথচ বায়ান্নর ২১ ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সেই থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই ২৬ ফেব্রুয়ারি ইডেন কলেজের ছাত্রীনিবাসে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রীরা এ সভায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের শপথ নেন। হত্যাকারীদের প্রকাশ্যে বিচার ও শাস্তি, মন্ত্রিসভার পদত্যাগ ও শহীদের মরদেহ ফেরত দেওয়ার দাবি জানান তারা। একুশের প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৩ সালে কলেজ কর্তৃপক্ষের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এ কলেজের ছাত্রীরা নির্মাণ করেন শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ। প্রভাতফেরি করে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করেন তাতে।
ভাষা আন্দোলনে ইডেন কলেজের মেয়েদের ভূমিকা প্রসঙ্গে ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চু সমকালকে বলেন, ‘ইডেন কলেজের মেয়েদের সভা-সমাবেশ ও মিছিলে অংশ নেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে ছাত্রীদের আনতে খুবই কষ্ট হতো। কারণ সুপারিনটেনডেন্ট ও প্রিন্সিপাল তাদের আসতে দিতেন না। তারা মনে করতেন, মেয়েরা ছেলেদের সঙ্গে মিশলে নষ্ট হয়ে যাবে।
কর্মসূচি থেকে ফেরার পর দারোয়ান আমাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে দিত না। মেয়েরা লুকিয়ে লুকিয়ে আসত। ইডেন কলেজকে কেন্দ্র করে পুরো আজিমপুর এলাকার মেয়েরা ভাষা আন্দোলনে সচেতনতার পরিচয় দেন এবং আমাদের সহযোগিতা করেন।’
১৯৫২ সালে ইডেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন অধ্যাপক ড. শরিফা খাতুন। সমকালকে তিনি বলেন, বায়ান্নর ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ধর্মঘট হয়, সেখানেও ইডেন কলেজের ছাত্রীরা অংশ নেন। সেদিন ইডেনের ছাত্রীরা পোস্টার লিখে তা বিতরণ করেন, চাঁদা তোলেন ও কালো ব্যাজ বিক্রি করেন। একুশের আন্দোলনে ইডেনের মেয়েদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্রীরা জেলখানায় আটক ছাত্রদের জন্য হোস্টেল থেকে রান্না করে খাবার নিয়ে যেতেন। বকশীবাজারের পুরনো ইডেন কলেজ ভাষা আন্দোলনের অনন্য স্মারক।
সূত্রঃ সমকাল