বাংলাদেশে ক্যারিয়ার গাইড | কোন পেশা সবচেয়ে ভালো

বাংলাদেশে ক্যারিয়ার গাইড অত্যন্ত দুর্বল। ফলে এদেশে অভিভাবকদের মূর্খতা, সামাজিক অজ্ঞতা এবং ছাত্রদের বেহুশ চিন্তায় অনেকের বহু রিসোর্স অপচয় হয়। এজন্য নিয়মতান্ত্রিক ইসলামি দাওয়াতের এটাও একটা দায়িত্ব যে তারা শিশু, কিশোর, তরুন এবং যুবকদের ক্যারিয়ার গাইড করবে। হালাল রিযক অর্জনে সিনিয়রদের অভিজ্ঞতা যেনো জুনিয়রদের পথ সহজ করে তা নিশ্চিত করা ইসলামি তাহরিকের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিৎ।
আমাদের দেশে মনে করা হয় অনার্সে ভর্তি হয়ে ক্যারিয়ার প্রিপারেশন শুরু করতে হবে। অত্যন্ত ভুল ধারণা। ক্লাস থ্রি, ফোর থেকে ক্যারিয়ার প্রিপারেশন শুরু করা উচিৎ। এজন্য প্রথমে অভিভাবকদের বুঝতে হবে যে বাচ্চার ক্লাসে ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হওয়ার পরিবর্তে ক্যারিয়ার ফোকাসড পড়াশোনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এই দুটোর ভেতর পার্থক্য কি?
ক্যারিয়ার ফোকাসড হওয়ার মানে স্কিল অর্জন। ধরেন ক্লাসে ফার্স্ট হতে চাইলে আপনাকে বাংলা বা সমাজ বা ধর্ম বইয়ের একটা প্রশ্নের উত্তর শুধু জানলেই হবেনা বরং উত্তরগুলো অনেকাংশে মুখস্থ করে বেশি মার্ক পাওয়ার উপযুক্ত করে লিখতে হবে। এখন মূল বিষয়টি জানার জন্য হয়তো আপনার বড়জোর আধা ঘন্টা পড়লেই চলতো। আবার প্রত্যেক শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক কিছু থাকে ছাত্রদের ইনডক্ট্রিনেশান বা মগজ ধোলাইয়ের জন্য যা আসলে কোন স্কিল তৈরি করে না। কিন্তু আপনি পরীক্ষায় খুব ভালো নম্বর পেতে সেই অপ্রয়োজনীয় বিষয়টির পেছনেও দশ পনেরো ঘন্টা বিভিন্ন সময় রিভিশন দিতে ব্যায় করেছেন। কিন্তু এই সময় যদি মার্কেট ভ্যালু আছে এমন কোনো স্কিল অর্জনে ব্যায় করতেন তাহলে আপনি পরীক্ষায় নম্বর কম পেলেও জীবন সংগ্রামে অধিক যোগ্য হয়ে উঠতেন।
বাংলা উচ্চারণটা বিশুদ্ধ হওয়া অত্যন্ত জরুরী। এটা সেক্যুলার এবং মাদ্রাসা উভয় ধারার শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। আমাদের দেশে অনেকের বাংলা অ্যালফ্যাবেটের উচ্চারণও সহিহ না। এটা অনেক ইউনিভার্সিটি গ্রাজুয়েটের ক্ষেত্রেও সত্য। কিন্তু ভাইভা বোর্ডে বিশুদ্ধভাবে ও পরিচ্ছন্ন এবং মার্জিত উচ্চারণ আপনাকে এগিয়ে দেবে অনেকটা। আমাদের রেডিও, টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর যারা সংবাদ উপস্থাপক তারাও প্রচুর ভুল উচ্চারণ করেন অনেক ক্ষেত্রে। শুদ্ধ উচ্চারণ শিখতে ইউটিউব এর সহযোগিতা নিতে পারেন। বাংলা একাডেমির উচ্চারণ ডিকশনারিও অত্যন্ত সহায়ক। স্কুল জীবনেই বাংলা বিশুদ্ধ উচ্চারণ শিখুন এবং রিহার্সাল করে বাংলা পড়তে এবং বক্তব্য দিতে অভ্যাস করুন।
আবারও বলি এটা স্কুল, মাদ্রাসা উভয় ধারার ছাত্রদের জন্যই উপকারী। শুধু বিশুদ্ধ উচ্চারণ বাংলাদেশের সীমানায় আপনার ক্যারিয়ারকে অনেকটা এগিয়ে দিবে৷ তবে আপনি যদি শুরুতেই নিশ্চিত থাকেন যে আপনি দেশের বাহিরে ক্যারিয়ার গড়বেন তাহলে এই বিষয়টি আপনার জন্য কিছুটা কম গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যারিয়ারে ভালো করার জন্য ইংরেজি শেখা অনিবার্য। আপনি স্কুল, আলিয়া বা কওমি যেখানেই পড়ুননা কেন আমাদের যুগে ভালো ক্যারিয়ারের জন্য ইংরেজি শেখা দুর্দান্ত রকম উপকারী। আপনি যেনো একটা আধুনিক ইংরেজি বই, পত্র পত্রিকা ডিকশনারি ছাড়া বুঝে পড়তে পারেন, ইংরেজি নিউজ, লেকচার বুঝতে পারেন এবং মোটামুটি কাজ চালানোর মতো স্পোকেন ইংলিশ পারেন তা নিশ্চিত করুন।
নোটঃ কিন্ডারগার্টেনে যেভাবে আনকমন ফুল, ফল, সবজি, মাছের নামের নাউন শেখায় তা আমার মোটেই পছন্দ না। আগে ভার্ব শেখা উচিৎ মনে করি। তবে ভোকাবুলারি শিখতে হবে প্রচুর।
ক্যারিয়ার চিন্তাটা অবশ্যই স্কুল জীবনেই করা উচিৎ। স্কুলেই আপনাকে পরিকল্পনা করতে হবে আপনি কি হতে চান? আপনাকে জানতে হবে আপনি যা হতে চান তা কিভাবে হওয়া যায়? এদেশে ছেলেমেয়েরা সবাই ডাক্তার হতে চায়। কিন্তু তাদের জানা নাই কিভাবে ডাক্তার হতে হয়। তাদের ধারণা Aim in life রচনা পর্যন্ত। তারা মনে করে সাইন্সে বায়োলজি নিয়ে পড়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে মেডিকেলে ভর্তি হবে। তারপর পাশ করে বের হলেই টাকাই টাকা। কিন্তু বাস্তবতা এতো সহজ না। মেডিকেলে পড়তে চাইলে অবশ্যই আপনাকে আউটস্ট্যান্ডিং হতে হবে। কম্পিটিশন অনেক টাফ। কিন্তু অনেক ছেলেরা অ্যারাউন্ড চার জিপিএ নিয়েও মেডিকেলের স্বপ্ন দেখে। তাদের ব্যাকয়াপ প্ল্যানও দুর্বল।
মেডিকেলে পড়ার ভর্তি পরীক্ষার একটা বড় সমস্যা হলো এর কোর্স ম্যাটেরিয়ালের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোর্স ম্যাটেরিয়াল র্যাডিকেলি ডিফার করে। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ সাবজেক্টগুলোর ভর্তির কোর্স ম্যাটেরিয়ালও সাধারণত অনেকটা আলাদা থাকে। ফলে একটা ডাক্তার হতে ইচ্ছুক ছেলের উচিৎ মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পুরো চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে ক্লাস এইটেই পুরোপুরি জানা। এজন্য কোনো মেডিকেলের দুই চারজন বড় ভাইয়ের সাথে আলাপ করা। তারপর ডাক্তার হলেই অনেক কিছু করে টাকার উপর ঘুমানো যাবে তাও না। অনেক হায়ার এডুকেশন এবং ভালো পড়াশোনা অত্যন্ত জরুরী। নয়তো অনেক মিডিওকার ডাক্তারের আয় রোজগার আহামরি না।
পরিচিত এক ছেলে বললো অস্ট্রেলিয়া যাবো পড়তে। সে জানেনা অস্ট্রেলিয়া কোথায়? তার ধারণা তার বাবা তাকে কয়েক লাখ টাকা দিবে। সে দেশীয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মতো বিমানে টিকিট কেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে হোটেল ভাড়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ভর্তি হয়ে যাবে। তাকে বললাম সাইফুর্স ভোকাবুলারি বইটা কিনে শেষ করো। বললো আব্বু বেতন পেলে কিনবো। এমাসে টাকা নাই। গত দুই বছরে সে বইটা কিনতে টাকা যোগাড় করতে পারেনি। ইচ্ছা হলে ঘুরে, গার্লফ্রেন্ড নিয়ে আড্ডা দেয়, বিভিন্ন ভালো রেস্টুরেন্টে খায়, সারারাত ফোনে কথা বলে। এমন অসংখ্য গল্প আমার জানা। এটাই এদেশের তরুণ প্রজন্মের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং।
যাইহোক কথা হলো আপনাকে অবশ্যই দুইটা কাজ করতে হবে।
১) আপনাকে বিকল্প পরিকল্পনা রাখতে হবে। প্ল্যান A, B, C ঠিক রাখতে হবে। একটা ফেইল করলে আরেকটা করবেন। সেটা ফেইল করলে আরেকটা করবেন। আমার প্ল্যান E পর্যন্ত সিরিয়াস প্রিপারেশন ছিলো। আল হামদুলিল্লাহ আমার ক্যারিয়ার প্যাথে সকল প্ল্যানই সাপোর্ট করেছে। প্ল্যান A অর্জনে বিকল্প প্ল্যানগুলোও আল হামদুলিল্লাহ কাজে এসেছে। আপনি হয়তো এতোটা পারবেননা। তবে পরিকল্পিত কাজ করলে অবশ্যই ফায়দা পাবেন। অবশ্যই ব্যাকয়াপ প্ল্যান রাখুন। সকল বিনিয়োগ এক ঝুড়িতে রাখবেননা।
২) আপনার প্ল্যানগুলো প্রজ অ্যান্ড কন সম্পর্কে স্কুলেই ধারণা রাখুন। আপনার নিজের এবং লক্ষ্যের সমন্বয়ে swot অ্যানালাইসিস করুন।অর্থাৎ অনার্স পাশ করে কি করবেন তা ক্লাস এইটে প্ল্যান করুন। যদি না করেন তবে এখনই করুন। কখনোই কাজটা না করার চেয়ে এখন করা ভালো।
আপনি যদি মনে করেন আপনার দ্বারা পড়াশোনা হবে না এবং পারিবারিক ব্যবসা করেই জীবন চালাবেন তাহলে ইন্টারমিডিয়েটের পরেই আপনার উচিৎ ব্যবসা নিয়ে কাজ শুরু করা। অযথা লোকাল ভাঙাচুরা কলেজে ডিগ্রি পড়ে সারা যাযাবরের মতো ঘুরে লাভ নাই। সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। এটাকে কাজে লাগান। দশ বছর আগে ব্যবসা শুরু করলে আপনি হয়তো আপনার উচ্চশিক্ষিত অধিকাংশ বন্ধুদের চেয়ে সহজে ক্যারয়ারে এগিয়ে যাবেন।
অনার্সে বিষয় চয়েস করা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিজ্ঞান অনুষদের সাবজেক্টগুলোতো ভালো। কিন্তু মানবিক ও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়তো বটেই এমনকি অর্থনীতির চেয়ে ‘বাংলা’ বিষয়টির ক্যারিয়ার অপরচুনিটি ভালো। আপনি বাংলা পড়ে সাধারণত প্রায় এমন সকল জব করতে পারবেন যা মানবিক বিভাগের অন্যান্য বিষয় পড়ে করা যায়। পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমনকি কোচিং সেন্টারগুলোতে বাংলা শিক্ষকতার অনেক জব পাওয়ার সুযোগ আছে যা অন্যান্য ক্ষেত্রে নাই। কারণ প্রায় সকল স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়তে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেকের বাংলা অনার্সের বিষয় না হলেও মাইনর কোর্স হিসাবে থাকে। সেখানেও বাংলা টিচার লাগে।
অধিকাংশ ছাত্ররা বাংলাদেশে এক বছর মাস্টার্সে নষ্ট করে। যারা চার বছরে অনার্স করে তাদের সাধারণত মাস্টার্স দরকার নাই। এভাবে আপনি এক বছর সময় বাঁচাতে পারেন। পাশাপাশি মাস্টার্সের অপ্রয়োজনীয় বিষয়াদি না পড়ে ক্যারিয়ার ওরিনেন্টেড এফোর্ট দিতে পারেন।
যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো হতে চেষ্টা করছেননা সাধারণত মাস্টার্স তাদের দরকার নাই।
আমি মাস্টার্সকে অপ্রয়োজনীয় বলেছি না। আমি বলতে চাইছি মাস্টার্স যত মানুষ বাংলাদেশে করে তাদের বড়জোর ৫% মানুষের ক্ষেত্রে মাস্টার্স কাজে লাগে। বাকি ৯৫% মানুষ কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সচেতন না। আপনার ক্যারিয়ার আপনাকে অ্যাসেস করতে হবে। প্রফেশনাল লাইফে থেকেও এক বছরের একটা মাস্টার্স কোর্স করা যায়। কিন্তু ক্যারিয়ারের ক্রুশিয়াল সময়ে এক বছর নষ্ট করার আগে বুঝে শুনে করা উচিৎ।
লিখেছেন – ফাইনাল নোটস (মীর সালমান)

About Nazmul Hasan

Hi! I'm Nazmul Hasan. From Koyra, Khulna. I'm Student of Under National University of Govt. B. L. College, Khulna, Department of Political Science....

Check Also

সরকারী চাকরির প্রস্তুতি

থিসিস পেপার লেখার নিয়ম

থিসিস পেপার লেখার নিয়ম। রিসার্চ পেপার লেখার নিয়ম। থিসিস পেপার যেভাবে লিখা যেতে পারে। প্রফেসর …