রায়হান আহমদ আশরাফী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত কলেজের অধিভুক্তির সুফল-কুফল দিয়ে লেখা শুরু করতে চাই না। পুরো লেখাটা জুড়েই লাভ ক্ষতির হিসেব মিলানো যাবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের বেশিরভাগই হতাশায় ভুগেন, এমন কথা প্রায়ই শোনা যায়। তবে ঢাবির অধিভুক্তি শিক্ষার্থীদের জীবনকে হতাশাগ্রস্থ করেছে আরো বেশি। নিজেদের পরিচয় হারিয়ে ফেলা, একাডেমিক কার্যক্রমে পিছিয়ে যাওয়াসহ কোনোদিকেই লাভ হয়েছে বলে শিক্ষার্থীদের চোখে পরে না। মোটের উপর লাভ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারি কলেজগুলোকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার কথা বলেছিলেন। তেমনি শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে প্রায় প্রতি বছরই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার কথাও তিনি বলেন। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে গেলেও ঢাবির সাবেক ভিসি সাত কলেজকে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই অধিভুক্ত করে নিলেন।
বিষয়টা অনেকটা এমন- চাকরি ছাড়াই বিয়ে করে সন্তানও নিয়ে নেয়া। বাবার সেই ভুল সিদ্ধান্তের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় সন্তানকে। ভালো খাবার জুটে না, ভুগে অপুষ্টিতে। জোড়াতালি দিয়ে অন্যের সহায়তা নিয়ে সন্তানকে বড় করতে হয়, যতদিন উপার্জনের ব্যবস্থা না থাকে।
সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অবস্থাও ঠিক তাই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্ধেক রেজাল্ট এনে, তার সাথে ভাইভার ফলাফল জোড়াতালি দিয়ে পরিয়ে দিতে হচ্ছে ছেলেমেয়েদের। ক্লাস কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলেও প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, ভাইভার সাথে সম্পৃক্ত থাকছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকরা। পরীক্ষা নেয়া, রুটিন প্রণয়ন, সময়মতো ফলাফল প্রকাশ সবকিছুতেই দীর্ঘ সময় লাগছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে চতুর্থ বর্ষের ফলাফল প্রকাশ হলেও, দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষাথীরা ঝুলে আছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মডারেশন শিক্ষার মান বাড়াবে বলে আশা করা যায়। প্রত্যেকটা উদ্যোগের সুফল পেতে কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। ঢাবির অধিভুক্তির সুফল পাওয়াও সময়ের ব্যাপার। মেনে নিলাম।
তার উপর আরেক হতাশা- ‘শিক্ষার্থীদের পরিচয়’। জন্মের পর সন্তান বাবার পরিচয়ে বড় হয়। কিন্তু এক ঘরে জন্ম নিয়ে অবুঝ শিশু যখন আরেক ঘরে দত্তক হয়ে যায়, তখন দত্তক বাবার পরিচয়টাই নিজের পরিচয় হয়। শিশুটা বাবার নাম জানতে চাইলে যে কাউকে দত্তক বাবার নামই বলেন। খুশি মনেই সে বাবার নাম উচ্চারণ করে। যখন ঐ ব্যক্তির আপন সন্তান মনে করিয়ে দেয় সে তোমার আপন বাবা নয়, তখন শিশুটি পরে যায় দোটানায়। নিজেকে ছোট মনে হয়, লজ্জিত মনে হয়। ভাবতে থাকে, না খাওয়াতে পারলেও আমার আপন বাবাই আমাকে রেখে দিতো। কিছু না পারি বাবার পরিচয়টা দিতে পারতাম।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের অবস্থাটাও তেমন হয়েছে। না পারে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয় দিতে, না পারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচয়ে পরিচিত হতে। আমার দেখামতে, বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই কোথায় পড়ো জানতে চাইলে, নিজের কলেজের নামই বলে থাকে। হাতেগোনা অল্প সংখ্যকই বোধহয় পরিচয় দেয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।
যতটুকু দেখেছি, বাইরের দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাফিলিয়েটেড কলেজের শিক্ষার্থীরা পরিচয় হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামই বলেন। যদিও তাদের অনেক প্রতিষ্ঠানেই স্নাতক পর্যন্ত পড়াশোনা অ্যাফিলিয়েটেড কলেজগুলোতেই হয়।
শেষে এসে বলতে হয়- “আমি কার খালু?” হয়ে থাকার ইচ্ছে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নেই। পরগাছা হয়ে থাকার চেয়ে আপন পরিচয়েই তারা সামনে যেতে চায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ শিক্ষার্থীদের পরিচয় বিষয়ক কোনো আইন-কানুন আছে কিনা জানা নেই। যদি থাকে, তবে সব শিক্ষার্থীদের জন্য তা বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে। না থাকলে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় যদি মনে করে, অধিভুক্তরা ঢাবি শিক্ষার্থী বলে পরিচয় দিতে পারবে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এ নিয়ে আন্দোলনের প্রয়োজন হবে না। আর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত যদি হয়, অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় দিতে পারবে না, সেক্ষেত্রে কেউ পরিচয় দিলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। একটা সুষ্ঠু সমাধানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং সাত কলেজের অধ্যক্ষদের পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবী!