অর্থনীতি কেন পড়বো ? পড়লে কি হওয়া যায়? তাদের জন্য।
কোনো বিষয়ে পড়ার জন্য আমরা যখন আগ্রহ প্রকাশ করি, আমরা বলি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ইঞ্জিনিয়ার হতে চাই, ব্যাংকিং পড়ে ব্যাংকার কিংবা সাংবাদিকতা পড়ে সাংবাদিক হতে চাই। তাহলে কি অর্থনীতি পড়ে অর্থনীতিবিদ হবো? মজাটা এখানেই। অর্থনীতি পড়ে তুমি যেকোনো পর্যায়ে যেতে পারবে। বিষয়টা ডাক্তারি পড়ে বিসিএস (পুলিশ ক্যাডার) এ যাওয়ার মতো না। সত্যিকার অর্থেই অর্থনীতি পড়ে অর্জিত জ্ঞান যেকোনো ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারো। হতে পারো তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, হতে পারো গবেষক, হতে পারো বহুজাতিক কোম্পানির ডিরেক্টর, হতে পারো আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, হতে পারো সমাজকর্মী, কিংবা হয়ে যেতে পারো বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর!
আসলে অর্থনীতি অনেক প্রসারিত একটি বিষয়। খেয়াল করলেই দেখবে স্টক মার্কেট থেকে শুরু করে বাড়ির পাশে ছোট বাজার কিংবা জাতীয় বাজেট থেকে শুরু করে ঘরের আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি। আমরা সবাই প্রতিদিনই অসংখ্য অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নিই, পার্থক্য শুধু আমরা জানিই না সেগুলো যে অর্থনীতির পাঠ্য।
তাহলে অর্থনীতিটা আসলে কী? অর্থনীতি হচ্ছে খুবই জীবন ঘনিষ্ঠ বিষয়। এটা প্রধানত সাহায্য করে সিদ্ধান্ত নিতে। অর্থনীতির মূল ধারণা হচ্ছে কীভাবে আমাদের কোনোকিছু পাওয়ার যে অসীম চাহিদা বা অপরিসীম অভাববোধ সেটাকে সীমিত সম্পদ দিয়ে কীভাবে পূরণ করা যায়। এই সম্পদ হতে পারে টাকা পয়সা, হতে পারে যেকোনো বস্তু বা দ্রব্য কিংবা সময়। এই স্বল্পপরিমাণ সম্পদ দিয়ে কীভাবে আমাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে সবচেয়ে এফিশিয়েন্টলি পূরণ করা যায় তাই শেখানো হয় এখানে। সেজন্য আছে বিভিন্ন চমকপ্রদ থিওরি, আছে অনেক গাণিতিক সূত্র, আছে অসংখ্য ডেফিনিশন। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে এই ক্ষেত্রে তুমি নিজের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে পারো। হয়তো এই যে সম্পদকে ইফেক্টিভলি ব্যবহার করা, তা নিয়ে তোমার মাথায় অভিনব আইডিয়া কিলবিল করছে। অর্থনীতির জ্ঞান থাকলে সহজেই এই আইডিয়াটা কতটুকু কার্যকর তা বের করে ফেলতে পারো। আর যদি সেই আইডিয়া হয় পৃথিবীকে বদলে দেবার মতো, তাহলে কে জানে অর্থনীতিতে নোবেলটাও তোমার হতে পারে!
সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি সামাজিক বিজ্ঞানের একটা স্ট্রিম, উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত এটা মানবিক বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। অথচ এটিই মনে হয় একমাত্র বিষয় যেখানে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা আর মানবিকের একটা অপূর্ব মেলবন্ধন পাওয়া যায়। একদিকে তুমি জানবে গণিত, একদিকে শিখবে বিজনেস স্ট্র্যাটেজি আবার অন্যদিকে পড়বে দেশ ও বিশ্বের রাজনীতি, সমাজ আর ইতিহাস নিয়ে। অর্থনীতির মতো এত বহুমুখী ভার্সেটাইল বিষয় দুটি নেই।
– কোর্স কয় বছরের হয়?
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অর্থনীতি বিষয়ক স্নাতক ডিগ্রি অর্জনে সাধারণত চার বছর ও মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করতে আরো এক বছর সময় প্রয়োজন হয়।
– কোথায় কোথায় পড়ানো হয়?
বাংলাদেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিগুলো বাদে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই (সরকারি ও বেসরকারি) সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের বিভাগ হিসেবে অর্থনীতি আছে। ডিগ্রী কলেজগুলোতেও ইকনোমিক্স বেশ কমন বিষয়।
– অর্থনীতিতে ৪ বছরের কোর্সে কি কি পড়ানো হয়?
অনার্স :
· মাইক্রো ইকোনোমিকস
· ম্যাক্রো ইকোনোমিকস
· গণিত
· পরিসংখ্যান
· ইকোনোমেট্রিকস
· হেলথ ইকোনোমিকস
· পাবলিক ইকোনোমিকস
· ফিন্যান্স
· একাউন্টিং
· কম্পিউটার ও সফটওয়্যার এনালাইসিস
· ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকস
· রিসার্চ মেথডোলজি
· এনভায়রনমেন্টাল ইকোনোমিকস
· বাংলাদেশের অর্থনীতি
· রাষ্ট্রবিজ্ঞান
মাস্টার্স :
· মাইক্রো ও ম্যাক্রো ইকোনোমিকস
· ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড
· বাংলাদেশের অর্থনীতিঃ সেক্টোরাল স্টাডিজ
· ইকোনোমিক মডেলিং
· প্যানেল ডাটা অ্যান্ড নন লিনিয়ার ইকোনোমেট্রিকস
· ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনোমিকস
– এসব বিষয়ে ভালো করতে হলে উচ্চমাধ্যমিকের কোন বিষয়গুলোয় দক্ষতা প্রয়োজন?
অর্থনীতিতে ভালো করতে হলে বিজ্ঞান থেকে গণিতে দক্ষতা থাকা আবশ্যক। কারণ অর্থনীতি আর গণিত পাশাপাশি চলে। ব্যবসায় শিক্ষা আর মানবিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক অর্থনীতি সাবজেক্টে দক্ষতা থাকতে হবে। ইন্টারে অর্থনীতি না থাকলে ঢাবিতে অর্থনীতি দেওয়া হয় না। তাই যেকোনো বিভাগ থেকে আসলেই গণিত এবং পরিসংখ্যান এই দুটি বিষয়ে ভীতি থাকা যাবে না।
– পড়ালেখার ধরন কি রকম হয়?
ইকোনমিকস থিওরিটিক্যাল বিষয়। তবে অনার্স ও মাস্টার্স এ গণিত, পরিসংখ্যান, ডাটা সায়েন্স এইসব কোর্স করানো হয় যা পরবর্তীতে অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন বাস্তব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে থাকেন।
– এই বিষয়ে পড়াকালীন কি কি এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির সাথে যুক্ত থাকা যায় যা পরবর্তীতে ক্যারিয়ার গঠনে হেল্প করবে?
অর্থনীতির পড়া জটিল হলেও একস্ট্রা কারিকুলার কার্যক্রমের যথেষ্ট সুযোগ থাকে। বিজনেস ক্লাব, ডিবেটিং ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, এম ইউ এন ক্লাব ইত্যাদি বিভিন্ন ক্লাবের মেম্বারশিপ এবং পোস্ট পরবর্তীতে কাজে লাগে। যদি পড়াশোনার পাশাপাশি এমন কোনো দায়িত্বে থাকা যায়, যেখানে সোশ্যাল এনগেজমেন্ট বেশি, নেটওয়ার্কিং করা যায়, ম্যানেজমেন্টের কার্যক্রম রয়েছে, অর্গানাইজেশন দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তবে ভবিষ্যতে সেটা সিভিতে গুরুত্ব বহন করে। এছাড়া জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিজনেস সামিট, ইকোনমিকস সামিট, এমইউএন ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতাও সাহায্য করে।
অর্থনীতি পড়ে চাকরির ক্ষেত্রে কি কি অপশন রয়েছে?
শুরুতেই বলেছি অর্থনীতি পড়ে কাজ করার সুযোগ বহুমুখী। ইকনোমিক্স যেহেতু রিসার্চ ওরিয়েন্টেড সাবজেক্ট, তাই পাশ করার পর সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা থাকে রিসার্চ অর্গানাইজেশানে। সিপিডি, বিআইডিএস, সানেম ইত্যাদি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে প্রতি বছর তরুণ মেধাবী অর্থনীতিবিদগণ তাদের ক্যারিয়ার শুরু করার সুযোগ পান। এরপর আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক এর পোস্ট। সাধারণ পদগুলোর পাশাপাশি শুধু স্ট্যাটিস্টিক্স আর ইকনোমিক্সের জন্য ডেডিকেটেড কিছু পোস্ট থাকে। এছাড়া বিসিএস পরীক্ষার ক্ষেত্রেও জেনারেল ক্যাডারের পাশাপাশি শিক্ষা ক্যাডারেও রয়েছে সুবর্ণ সুযোগ । এর বাইরে থাকে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ব্যাংক, কন্সাল্টেন্সি ফার্ম, এনজিও, কলেজের প্রভাষক ইত্যাদির সুযোগ।
এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন যেমন বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি, আইএমএফ ইত্যাদি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানে রয়েছে চাকরির সুযোগ। আর বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ফিন্যান্স এডভাইজার সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট তো রয়েছেই।
– অর্থনীতি বিষয়ে পড়ে লেকচারার হওয়ার সুযোগ কেমন?
অর্থনীতি যেহেতু এখন বেশ অনেকগুলো ইউনিভার্সিটিতে পড়ানো হয় তাই পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হওয়ার বেশ ভালো সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে নর্থ অ্যামেরিকান একটা ডিগ্রী থাকলে শুরুতেই প্রভাষকের জায়গায় এসিস্টেন্ট প্রফেসর হিসাবে শুরু করা যায়। এটা অলিখিত নিয়ম।
–
– অর্থনীতির পড়াশোনা শেষ করে কোন দেশগুলো যাওয়ার সুযোগ রয়েছে?
অনার্স মাস্টার্স দুইটাতেই ইকোনোমিকসের স্কলারশিপ অপরচুনিটি বেশি। বিশেষত কানাডা বা নর্থ অ্যামেরিকার দিকে এশিয়া থেকে প্রতিবছর প্রচুর ছাত্রছাত্রী পড়তে যায়। তুলনামূলক কঠিন কারিকুলাম হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু এশিয়ার সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা পড়ায়, তাই এখান থেকে যাওয়া স্টুডেন্টরা ভালো করে আসছে গত ২০-২৫ বছর ধরে। এজন্যে এই সুযোগগুলো বাংলাদেশ থেকে বেশ ভালোভাবে পাওয়া যায়।
–
আগ্রহ নিয়ে অর্থনীতি পড়লে অনেক বড় বড় সুযোগ তোমার দরজায় কড়া নাড়তে পারে। শুধু প্যাশন থাকতে হবে, ভালো করার ইচ্ছা থাকতে হবে। পুঁথিগত পড়াশোনার পাশাপাশি এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে। সবরকম অভিজ্ঞতা অর্জনের মানসিকতা থাকতে হবে। পড়াশোনার চাপ থাকবেই, কিন্তু তাতে দমে গেলে চলবে না। চোখ কান খোলা রাখতে হবে। লক্ষ্য স্থির রেখে প্রস্তুতি নিতে হবে শুরু থেকেই। অর্থনীতি বিশাল এক সম্ভাবনার নাম, তাদের জন্য, যারা এতে নিজের শ্রম, মেধা, যোগ্যতা ও অর্জন বিনিয়োগ করতে রাজি।
অর্থনীতি যাদের জন্য নয় :
ছোটবেলা থেকে যাদের গণিত ভীতি রয়েছে ও যারা পড়াশোনায় পর্যাপ্ত ইফোর্ট দিতে পারেন না , তাদের বিষয়টি মোটেও নির্বাচন করা উচিত নয়!