মার্কসীয় ভঙ্গিতে “বেকার তত্ত্ব”: আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই গ্রাজুয়েশন শেষ করি না কেন, আমরা বিগত চার পাঁচ বছরে আসলেই কী শিখতে পেরেছি তা ভেবে দেখার বিষয়। কেউ যুক্তি দিবে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয় তেমন মান সম্মত ছিল না; কেউ বলবে সরকারি কলেজ, তাই ঠিকমতো ক্লাসই হতো না; আবার কেউ অকপটে নিজের দোষও স্বীকার করে বলবে আমি নিজেও ঠিকমতো পড়াশোনা করিনি। কারণ যাই হোক দিন শেষে আপনি আমি গতিশীল এই বিশ্বব্যবস্থা থেকে যে এখনও অনেক দূরে এটিই সত্যি। সমাজ বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, ইতিহাস সহ বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী হাজার হাজার শিক্ষার্থী আজ গতিহীন, এবং হতাশায় নিমজ্জিত।
আমি নিজে যখন অনার্সের ক্লাশ নিতাম তখন আমি শুনতাম আমার প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের কতশত অভিযোগ । তাদের মন্তব্য, “আমরা নিজ পছন্দে এই বিষয়ে ভর্তি হয়নি কিংবা ওমুক স্যার/ম্যামের ক্লাশ বুঝিনা, তাই এই বিষয়ে পড়তে ভালো লাগে না”, ইত্যাদি ইত্যাদি।
অনার্সের এক স্টুডেন্টকে একবার আমি প্রশ্ন করলাম, “রাষ্ট্রবিজ্ঞান থেকে অনার্স শেষ করে তুমি জীবনে কী হতে চাও?” সে উত্তর দিল, “স্যার আমি ডাক্তার হতে চাই” এই উত্তর শুনে আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। ভাবলাম সে হয়তো ‘ডক্টরেট’ কে ভুলে ‘ডাক্তার’ বলে ফেলছে। তাই আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি ডক্টরেট বললে না ডাক্তার?” এবার তার উত্তর, “ওই একই তো স্যার। বাংলায় ডাক্তার বলে আর ইংরেজিতে ডক্টরেট, অর্থ তো একি, চিকিৎসক”। তার এই মন্তব্য শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। যাইহোক হয়তো সবাই একই রকম মেধা নিয়ে জন্মায় না।
অনেকেই হয়তো এই ডক্টরেট আর ডাক্তারের পার্থক্য জানে। তবুও শিক্ষক হিসেবে নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছিল সেদিন। দেশব্যাপী শতশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা শিক্ষকরা কী পড়াচ্ছি, কিংবা শিক্ষার্থীরাই বা কী শিখছে এই চিন্তায় আমার এখনও মাঝে মাঝে রাতে ঘুম হয়না। ব্যতিক্রম হয়তো আছে, তবে তার সংখ্যা নেহাতই নগন্য। সমাজবিজ্ঞানের অধীন বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্র ছাত্রীদের পড়াশোনা ও তাদেরকে যুগোপযুগী করে গড়ে তোলার পেছনে বেশ কিছু কমন সমস্যা আমার চোখে ধরা পড়েছে:
ক) ৯৯.৯৯% স্টুডেন্ট স্বেচ্ছায় ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজ কর্মের মতো বেশ কিছু বিষয়ে ভর্তি হয়না, তাই এ বিষয়ে ভালোভাবে পড়ার কোন রকম আগ্রহ তাদের নেই।
খ) বিভিন্ন কারণে সরকারি কলেজের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কম। এছাড়াও অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রী HSC-এর পর ঢাকায় চলে আসে, আর বুঝে না বুঝে বিভিন্ন বেসরকারি কলেজে ভর্তি হয়ে যায়।
গ) বেসরকারি কলেজে মানসম্মত শিক্ষকের অভাব। তিন জন শিক্ষক থাকলে একজনের ক্লাশ শিক্ষার্থীরা করে আর বাকি দুইজনের ক্লাশ মায়ের ভোগে। এভাবে চার বছরে তারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ কোর্সের কিছুই শিখতে পারেনা। বিশেষ করে যে কোর্সগুলো ক্যারিয়ার লেভেলে খুব বেশী দরকার, যেমন: রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্টুডেন্ট হলে “রাজনৈতিক তত্ত্ব ও সংগঠন”, “স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস”, “লোক-প্রশাসন ও বাংলাদেশের লোক-প্রশাসন” ইত্যাদি। খোদ ঢাকা শহরের অনেক বেসরকারি কলেজে এ কোর্সগুলো অনেক শিক্ষকই পড়াতে চায় না, কেননা তারা নিজেরাই এগুলো ভালো করে বোঝেনা। আবার দেখা যায়, “স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস” পড়ানো হচ্ছে সমাজ কর্মের শিক্ষক দ্বারা। তারা মনে করে এই বিষয়টি খুবই সহজ তাই যে কেউই হয়তো এটা পড়াতে পারে। কী হতভাগা আমরা! ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ কোর্সগুলোতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছাত্রীদের দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো।
ঘ) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টরা হয়তো নিজের চেষ্টায় তাদের দুর্বলতা কাটাতে চেষ্টা করে, তারপরও এখানে সমস্যার অন্ত নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি আজ বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরী হয়ে গেছে। বিভাগীয় বিষয়ে পড়াশোনা করতে এখানে খুব কম স্টুডেন্টরাই এখন যায় বলে পত্র পত্রিকাতেও খবর বের হয় আজকাল। এছাড়াও আছে শিক্ষকদের শিক্ষাদানের মান নিয়ে প্রশ্ন। তারা যে অনেক মেধাবী তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ‘অনেক মেধাবী হলেই কি কেউ ভালো পড়াতে পারেন কিনা’- এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় এসেছে।
ঙ) সামাজিক বিজ্ঞানের অধীন বিভিন্ন বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করা অনেক স্টুডেন্ট বাংলা ব্যাকরণ, অঙ্ক, ইংরেজি, সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানে ভয়াবহভাবে দুর্বল। অথচ বর্তমান চাকরির বাজারে এ বিষয়গুলো কতো গুরুত্বপূর্ণ তা সবারই জানা। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর এ ব্যাপারে ভেবে দেখা উচিৎ। কোর্স আকারে এ বিষয়গুলো যদি রাখা যায় তাহলে উত্তম। অথবা সহশিক্ষা কার্যক্রমের অধীন হলেও এগুলো রাখা উচিৎ। এর অভাব স্টুডেন্টরা দিন দিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মারাত্মকভাবে পিছিয়ে যাচ্ছে।
এভাবেই দিন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্টুডেন্টদের হাতে একটি সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিচ্ছে আর শিক্ষার্থীরা বছরের পর বছর বেকার হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত থাকছে। আর এ থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে কার্ল মার্কসের সমাজতন্ত্রের নতুন আরেক রূপ।
এতে করে তিন স্তরের একটি নতুন শ্রেনী ভিত্তিক কাঠামো ইতোমধ্যেই সমাজে তৈরি হয়ে গেছে:
- প্রথম শ্রেণী: খুব সামান্য একটা অংশ তাদের পছন্দের চাকরি পেয়ে বা ব্যবসা বাণিজ্য করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ দেশের জন্য অবদান রেখে চলেছে, আবার কেউ কেউ তাদের বিদ্যেবুদ্ধির অপপ্রয়োগ করে দেশের বারোটা বাজাচ্ছে। এই প্রথম শ্রেণীকে মার্কসের ভাষায় “বুর্জোয়া শ্রেণী” বলা যেতে পারে।
- দ্বিতীয় শ্রেণী: এরা হলো “পাতি বুর্জোয়া শ্রেণী”। বুর্জোয়া হওয়ার নেশায় এরা মত্ত। এদের সংখ্যা নেহাত কম নয়, তবে তা বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে অনেক কম বলা যায়। এই শ্রেণী হয়তো মান সম্মত চাকরি পাচ্ছে, তবুও সেটা তাদের মনের মতো নয়। তাই তারা অফিসে বসেও বিসিএস বা অন্য কোন তুলনামূলক ভালো জবের জন্য পড়ছে, কিংবা কাজের ক্ষেত্রে তাদের ফুল কনসেনট্রেশন থাকছে না। এতে করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে প্রাপ্য সর্বোচ্চ সেবা হারাচ্ছে। চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ।
- তৃতীয় শ্রেণী: সবচেয়ে বড় এই শ্রেণীর নাম অসহায় “বেকার শ্রেণী”। এরা বছরের পর বছর চেষ্টা করেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারছে না। এদের মধ্যে আবার সংখ্যাগরিষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে সমাজ বিজ্ঞানের অধীন বিভিন্ন বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারি বেসরকারি কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যে এই তালিকায় নেই তেমনটাও নয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার ছোট খাট এমন কিছু কাজ করছে যা তারা কাউকে বলতেও পারেনা, এমনকি নিজের বাবা মাকেও বলতে লজ্জা পায়, কেননা তাদের এই কর্ম কাজের কোন সংজ্ঞাতেই পারেনা। ব্যক্তিগতভাবে আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি, এদের অধিকাংশই একজন রিকশাচালক কিংবা একজন পোশাক শ্রমিকের চেয়েও কম পারিশ্রমিকে লজ্জায় বুকভরা কষ্ট নিয়ে দুবেলা দুমুঠো ভাতের আশায় কাজ করে যাচ্ছে। এদের জীবনের যে কী কষ্ট তা হয়তো কোন কালিতেই লেখা যাবে না, কিংবা কোন শব্দেই বলে বোঝানো যাবে না। হতাশা, দুশ্চিন্তা, সামাজিক অবমাননা এদের রক্তেরই আরেক উপাদান। আর তাই, একটা সময় পর এ বিষয়গুলো তাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে যায়। কোন অপমান বা অবমাননাই আর তাদেরকে কষ্ট দেয় না। কেউ যদি খুব বেশি অসহায় বোধ করে, তাহলে সে খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের জীবনটা বিলিয়ে দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে যায়, “তোরা বুর্জোয়া আর আমি ছিলাম বেকার”। এদের সংখ্যা যেহেতু সর্বাধিক, তাই কার্ল মার্কসের শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের মতো কোনো না কোনো দিন এদের দ্বারাই হয়তো “বেকার সংগ্রাম” সাধিত হবে। সে দিন বুঝি আর বেশি দূরেও নয়।
লেখাঃ নাজমুল হাসান
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়