বর্ণাঢ্য আয়োজনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন। দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। মঙ্গলবার (২৭ ডিসেম্বর) গাজীপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসে একাডেমিক ভবনের সামনে সকাল সাড়ে ১০টায় শান্তির প্রতীক পায়রা এবং বেলুন উড়িয়ে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। উদ্বোধন শেষে একাডেমিক ভবনের সামনে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বে আনন্দ র্যালি বের হয়। র্যালিটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে নতুন ডরমেটরি ভবনের সামনে অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে শেষ হয়।
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান। ৩০ পাউন্ড ওজনের কেক কেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করা হয়।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ. ক. ম. মোজাম্মেল হক এমপি বলেন, ‘বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অত্যন্ত সফলভাবে তারা সারাদেশের অধিভুক্ত কলেজগুলোর শিক্ষার মান উন্নয়নসহ শিক্ষাপ্রশাসন পরিচালনা করছে। যদিও এই কাজ অত্যন্ত কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের। দেশের ২২৫৭টি কলেজের শিক্ষাব্যবস্থাপনা, পরিচালনা পর্ষদ গঠন, মান উন্নয়নসহ নানাবিধ কাজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সামলাতে হয়। তবে আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কারিগরি শিক্ষা, কর্মমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো উচিত। কারণ এসব ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি সৃষ্টি হয়।’
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বক্তা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি বলেন, ‘দেশের মানচিত্রসম বিস্তৃতি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। বর্তমান সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষতাভিত্তিক কর্মমুখী শিক্ষার প্রসার ঘটানোর জন্য অনেক নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করছি উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে এসব নব নব উদ্যোগ কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। আমরা রূপকল্প ২০৪১ নিয়ে এগোচ্ছি। আমরা আগে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম। এটি এখন বাস্তব। এখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। সকল দিক থেকেই আমরা চৌকস হয়ে উঠবো। আমাদের সরকার, শিক্ষা ব্যবস্থাসহ সকল ক্ষেত্রে স্মার্ট হবো। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আগে শিক্ষাখাতকে স্মার্ট করতে হবে। এজন্য সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আমাদের আন্তর্জাতিক ও জাতীয় কতগুলো লক্ষ্য রয়েছে। সেগুলো আমরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অর্জন করতে সক্ষম হবো।’
শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য উচ্চশিক্ষার বড় ভূমিকা রয়েছে। এই উচ্চশিক্ষার ৭০ শতাংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের স্বপ্ন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় একটি অংশ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের সন্তান। এই সন্তানরাই আমাদের দেশটাকে পাল্টে ফেলতে পারে। বিসিএসের গত কয়েক বছরের ফলাফলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক মাস্টার প্লানের কাজ অনেকটা এগিয়েছে। তারা নিরন্তর চেষ্টা করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নয়নে।
তারা খুব শিগগিরই ১৯টি দক্ষতাভিত্তিক শর্টকোর্স চালু করতে যাচ্ছে। এসব নতুন নতুন কোর্স চালু হয়ে গেলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফল্য সারাদেশকে পথ দেখাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগভিত্তিক যে আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস করা হলে আরও ভালোভাবে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। আমরা যে বিষয়েই পড়ি না কেন আমাদের আইসিটি, সফট স্কিল-এসবের দক্ষতা থাকতে হবে। এগুলো প্রত্যেক বিভাগের মধ্যে এমভেড করে দিতে হবে। এসকল কার্যক্রমের মাধ্যমেই মানবিক ও স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরি হবে।’
সভাপতির বক্তব্যে উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান বলেছেন, ‘বিজয়ের এই মাসে গৌরব এবং অহংকারের বীরত্বকে কাঁধে নিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে একান্নতে পা দিয়েছি আমরা। বাংলার শৌর্য-বীর্য, গৌরবকে ধারণ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর নেতৃত্বে অদম্য গতিতে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে চলছে বাংলাদেশ। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পার করছে। মূলত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে গঠিত কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের আলোকে প্রতিষ্ঠিত হয় এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান। মানচিত্রসম বিস্তৃতিকে ধারণ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ৩০ বছরে বিজয়ের এই মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, কর্মকর্তা- কর্মচারীদের স্বাগত জানিয়ে উপাচার্য ড. মশিউর রহমান বলেন, ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২২৫৭টি কলেজে যেসব শিক্ষার্থীরা অধ্যয়নরত আমরা চাই তাদের জীবন-যাত্রায় নতুন চিন্তা, সৃজনশীলতা এমনভাবে আছরে পড়ুক যাতে করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত আধুনিক স্মার্ট নাগরিক হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারে। বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বপ্ন স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে তারা যেন যোগ্য নাগরিক হয়। আমাদের সন্তানেরা মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ঘরের সন্তান। কিন্তু তাদের মধ্যে যে অদম্য আগ্রহ, কাজ করার যে স্পৃহা, শিক্ষাগ্রহণের যে চেষ্টা সেটি অদম্য। কারণ তারা হাজারো চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে উচ্চবিত্ত পরিবারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবন সংগ্রামে নিজের পাঠ্যক্রম চালিয়ে সমাজ পরিবর্তনের জন্য নিজেকে তৈরি করে।’
,
দেশের প্রথিতযশা এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, ‘আমরা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে সত্যিকার অর্থেই একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চাই। সেকারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস অবশ্যপাঠ্য করা হয়েছে। আমরা অ্যাকাডেমিক মাস্টার প্লান তৈরি করেছি। ইতোমধ্যে ১২টি পিজিডি কোর্স চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ১৯টি শর্ট কোর্স চালু করতে যাচ্ছি। আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে অনার্স ১ম বর্ষে আইসিটি এবং তৃতীয় বর্ষে সফট স্কিল অবশ্যপাঠ্য হিসেবে চালু হবে। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগতে, মননে, মানসে নতুন সমাজের স্বপ্ন বুনে দিতে চাই। যে ৩০ লক্ষ মানুষ লাফিয়ে লাফিয়ে প্রাণ দিয়ে লাল-সবুজের পতাকা আমাদের হাতে তুলে দিয়ে গেছে।
যে দু’ লক্ষ মা-বোন নির্যাতন সয়ে লাল-সবুজের পতাকা দিয়ে গেছেন, তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই আগামীর প্রজন্মকে গড়ে তুলতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বিজ্ঞানমনস্কতার সমন্বয়ে আমাদের শিক্ষার্থীরা কর্মনিষ্ঠ হোক। আমরা এই সমাজকে বদলে দিতে চাই। আসুন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠুক বাংলাদেশ পরিবর্তনের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার- আমাদের সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তুলবো- বিশ্ব দরবারে তারা যেন গর্বিত বাঙালি হয়।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ যেমন সামরিক শাসনের যাঁতাকলে ছিল। ঠিক তেমনি শিক্ষাব্যবস্থায়ও নাজুক পরিস্থিতি ছিল। গোটা জাতিকে ভুল ইতিহাসের মধ্যে নিমজ্জিত করা হয়েছিল। সেটির বিপরীতে তরুণ প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট চালু করা হয়। বাংলাদেশের আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলার পবিত্র দায়িত্ব জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে এর নবসৃষ্টি, নবধারাকে আমরা এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই যেখানে প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযোদ্ধারা প্রশান্তি পাবে। প্রতিটি সন্তানকে দেশপ্রেমিক সুনাগরিক, সৃজনশীল, বিজ্ঞানমনস্ক নাগরিক হিসেবে গড়া তোলা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের প্রজন্ম এমনভাবে গড়ে উঠবে, তারা যেন স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের যোগ্য প্রতিনিধি হয়।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি এমপি, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সিমিন হোসেন রিমি এমপি, সংসদ সদস্য শামসুন নাহার, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. হাবিবুর রহমান, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. নিজামউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. নাছিমা বানু। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মোল্লা মাহফুজ আল-হোসেন। অনুষ্ঠান শেষে জাতীয় সংসদ সদস্য ও সংগীত শিল্পী মমতাজ বেগম, সরকারি সংগীত কলেজসহ জাতীয় পর্যায়ের শিল্পীদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়।