দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সরকার শিক্ষার্থীপিছু সবচেয়ে বেশি ব্যয় করে নতুন প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে। এখানে শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয় সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি। আর শিক্ষার্থীপ্রতি সবচেয়ে কম খরচ করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এখানকার একজন শিক্ষার্থীর পেছনে খরচ মাত্র ১ হাজার ১৫১ টাকা। অথচ উচ্চশিক্ষায় সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয়ে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে।
উচ্চশিক্ষা দেখভালের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীর মাথাপিছু ব্যয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ২০২০ সালের তথ্য নিয়ে সর্বশেষ এ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়েছে। এখন ২০২১ সালের প্রতিবেদন তৈরির জন্য তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে।
বৈষম্যঃ শিক্ষার্থীপ্রতি সবচেয়ে কম খরচ করা হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ১১৫১ টাকা
বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় কমবেশি হতে পারে। যেমন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম, কিন্তু মোট বরাদ্দ বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় বেশি হতে পারে।
- মোহাম্মদ আবু ইউসুফ,
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক
তবে মাথাপিছু ব্যয়ের হিসাব বের করার পদ্ধতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। কারণ, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন ও অবসর সুবিধার খরচের টাকাও যেমন এখানে আছে, আবার আনুষঙ্গিক আরও কিছু খরচও আছে। সঙ্গে আছে গবেষণা অনুদান। এখানে মূলত অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ ও যন্ত্রপাতি কেনা ছাড়া বার্ষিক বাজেটে যে ব্যয় দেখানো হয়, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী দিয়ে ভাগ করে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের হিসাবটি করা হয়।
বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় কমবেশি হতে পারে। যেমন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম, কিন্তু মোট বরাদ্দ বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় বেশি হতে পারে। আবার বিজ্ঞান ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেশি হয়। এ বিষয়ে ইউজিসির পক্ষ থেকে একটি যথাযথ ব্যাখ্যা থাকা দরকার। তবে তাঁর মতে, শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই সমতা থাকা উচিত।
বর্তমানে সারা দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৫২টি। এর মধ্যে কয়েকটি এখনো পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেনি। ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব বলছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিভুক্ত কলেজ, মাদ্রাসাগুলো বাদে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মোট শিক্ষার্থী ৩ লাখ ১৪ হাজার ৯৩০ জন। তবে কলেজ, মাদ্রাসাসহ মিলিয়ে উচ্চশিক্ষায় মোট শিক্ষার্থী আছে ৪৩ লাখ ৬২ হাজার ১৮৭ জন।
ইউজিসির সচিব ফেরদৌস জামান প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আছে। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ে একেবারেই অপ্রতুল, যা দিয়ে কোনোভাবেই ভালোমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি সম্ভব নয়। ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনতে হবে।
ইউজিসির তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজ আছে ২ হাজার ২৫৭টি। এগুলোতে শিক্ষার্থী পৌনে ৩০ লাখ। মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে স্নাতক সম্মানে প্রায় ১৫ লাখ। বাকিরা পাস কোর্সসহ অন্যান্য স্তরের। এখানে সরকার থেকে রাজস্ব খাতে কোনো বরাদ্দ দেওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীপিছু ব৵য় করে থাকে নিজস্ব আয় থেকে। তবে এই নিজস্ব আয়টি হয় মূলত শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই নেওয়া ফির মাধ্যমে। এখানে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে বছরে খরচ হয় মাত্র ১ হাজার ১৫১ টাকা।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয় ১ লাখ ৯২ হাজার টাকার বেশি। একই ধরনের রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় হয় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বেশি, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি। আর ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যয় ১ লাখ ৯১ হাজারের বেশি।
দূরশিক্ষণের মাধ্যমে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষার্থী পড়ায় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু ব্যয়ও তুলনামূলক কম—১ হাজার ৭৮৬ টাকা। ইউজিসি বলছে, এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় অনেক কম হওয়ায় এখানকার শিক্ষার মানও কমে যাচ্ছে। শিক্ষার মান উন্নত করতে সেখানে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের গুণগত মানের একটি তুলনামূলক চিত্র বোঝা যায় বিআইডিএসের এক জরিপে। গত বছর করা ওই জরিপের তথ্য বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার থাকছেন।
ইউজিসি জানিয়েছে, সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চেয়ে বিজ্ঞান, চিকিৎসা, প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় বেশি। যেমন শিক্ষার্থীপিছু সবচেয়ে বেশি ব্যয় হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ববিদ্যালয়। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ২০১৮ সালে বিশেষায়িত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও এখানে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়াশোনা শুরু হয় পরের বছর। বর্তমানে মোট শিক্ষার্থী দুই শতাধিক।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয় ১ লাখ ৯২ হাজার টাকার বেশি। একই ধরনের রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যয় হয় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার বেশি, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি। আর ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ ব্যয় ১ লাখ ৯১ হাজারের বেশি।
অন্যদিকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় প্রায় ৪ লাখ টাকা। সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা ২ লাখ ৫৯ হাজার টাকা এবং গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩ লাখ ৪২ হাজার টাকা। আর চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ব্যয়ে প্রায় তিন লাখ টাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের ব্যয়ে গোলমেলে তথ্য
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ৩৭ হাজারের মতো। ইউজিসির প্রতিবেদনে ২০২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয় দেখানো হয়েছে ২১ হাজার ২৩৮ টাকা। তার আগের বছরও এই ব্যয় দেখানো হয় ২১ হাজার টাকার কিছু বেশি। কিন্তু ২০১৮ সালে এই ব্যয় ছিল প্রায় ১ লাখ ৮৮ হাজার টাকা।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এখানে ইউজিসি ভুল করেছে। প্রকৃতপক্ষে ২০২০ সালে শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয় ছিল ২ লাখ ১২ হাজার টাকার মতো। আর ২০২১ সালের যে হিসাব ইউজিসিতে পাঠানো হয়েছে, তাতে শিক্ষার্থীপিছু সরকারের খরচ ১ লাখ ৮৫ হাজার ১২৪ টাকা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীপিছু সরকারের বার্ষিক ব্যয় দেখানো হয়েছে ২৩ হাজার ৯৬০ টাকা। অথচ ২০১৯ সালে এ ব্যয় দেখানো হয়েছিল পৌনে দুই লাখ টাকা। তার আগের বছর আরও বেশি ছিল। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এখানেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হিসাবে গরমিল করে লেখা হয়েছে।
শিক্ষার্থীপ্রতি মাথাপিছু ব্যয়ের পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা বাজেট বিষয়ে অভিজ্ঞ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় কমবেশি হতে পারে। যেমন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম, কিন্তু মোট বরাদ্দ বেশি হওয়ায় শিক্ষার্থীপিছু ব্যয় বেশি হতে পারে। আবার বিজ্ঞান ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন খাতে ব্যয় বেশি হয়। এ বিষয়ে ইউজিসির পক্ষ থেকে একটি যথাযথ ব্যাখ্যা থাকা দরকার। তবে তাঁর মতে, শিক্ষার্থীপিছু ব্যয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই সমতা থাকা উচিত।
সোর্স এবং লিংকঃ প্রথম আলো